
বিপ্লব রায়।।
আশির দশক বা তারও আগে বাঙলা সাহিত্য পড়েছেন, কিন্তু হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর নাম শোনেননি, এমন বুঝি কেউ নেই। তিনি বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির অমূল্য এক রত্ন। ১৯০৭ সালে তার হাত ধরেই প্রচলন হয় বাংলার আদি কবিতা-সংগ্রহ চর্যাগীতির পুঁথি। বাংলা ও সংস্কৃত ভাষার অনন্য দিকগুলো আবিষ্কার করেছেন ড. হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। শুধু তাই নয়, চর্যাগানের সংকলন আবিষ্কার, সম্পাদনা এবং বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের গবেষণায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর অবদান অনস্বীকার্য। তাঁর জীবন ছিল যেন এক অবিরাম সাধনা। তাইতো ড. হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ছিলেন পণ্ডিত, বাংলা গবেষক, সাহিত্যিক ও ইতিহাসবিদ।
ব্রিটিশ বাংলা প্রদেশের (বর্তমান বাংলাদেশ) খুলনা জেলার কুমিরা গ্রামের কীর্তিমান সন্তান হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। তার আসল নাম ছিল হরপ্রসাদ ভট্টাচার্য। তাঁর আদি নিবাস ছিল ভারতের উত্তর ২৪পরগনা জেলার নৈহাটিতে। যদিও নতুন প্রজন্ম গুণী এই মানুষটির নামও জানে না। তাঁর চর্চা তো দূরের কথা। বিখ্যাত বাঙালি ভারততত্ত্ববিদ, সংস্কৃত বিশারদ, সংরক্ষণবিদ ও বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস রচনা করেছেন তিনি। সন্ধ্যাকর নন্দী রচিত রামচরিতম্ বা রামচরিতমানস পুঁথি সংগ্রাহও করেছিলেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী।
মহা এই গুণীর জীবন ছিল সংগ্রাম ও পরিশ্রমের। ভারতের প্রাচীন সাহিত্য, সংস্কৃত কবিতা এবং পুরাণের গভীরতা উন্মোচন করেছিলেন তিনি। যা আজও আমাদের জন্য অমূল্য সম্পদ।
কোলকাতায় পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সঙ্গে থাকতেন হরপ্রসাদ। কারণ বিদ্যাসাগর ছিলেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর বড়দা নন্দকুমার ন্যায়চঞ্চুর বন্ধু। তাই হরপ্রসাদকে খুব স্নেহ করতেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।
বিএ পরীক্ষায় সংস্কৃতে প্রথম হয়েছিলেন হরপ্রসাদ। আর সে কারণে প্রতি মাসে ৫০ টাকা ‘সংস্কৃত কলেজ স্নাতক বৃত্তি’, ৫ টাকা ‘লাহা বৃত্তি’ পেতেন তিনি। এক সময়ে ‘রাধাকান্ত দেব মেডেল’ লাভ করেন হরপ্রসাদ। এভাবে ১৮৭৭ সালে সংস্কৃতে সাম্মানিক ও পরে এমএ পাস করে ‘শাস্ত্রী’ উপাধি লাভ করেন তিনি।
১৮৭৮ সালে তিনি হেয়ার স্কুলে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। ১৮৮৩ সালে সংস্কৃত কলেজে শুরু হয় তাঁর অধ্যাপনা জীবন। সেখানেই কেটে যায় হরপ্রসাদের প্রায় ২৫টি বছর। ১৯০৮ সালে সেই কলেজ থেকে অবসর নিয়ে যোগদেন সরকারি তথ্যকেন্দ্রে। এর মধ্যে ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যায় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর যোগ দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ও সংস্কৃত বিভাগের অধ্যাপক এবং বিভাগীয় প্রধান হিসেবে। এই দায়িত্বে কাটে তাঁর তিন বছর। এই তিন বছরেও বাঙলা নিয়ে করেছেন বিস্তর গবেষণা। ছড়িয়ে দিয়েছেন শিক্ষার্থীদের মধ্যে। তাঁর সেই শিক্ষার্থীদের বেশিরভাগই এখন বেঁচে নেই। কিন্তু হরপ্রসাদের সেই জ্ঞানের আলো আজো বিকিরণ ছড়াচ্ছে বাঙালির হৃদয়ে।
জীবদ্দশায় বহু বই লিখেছেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। এর মধ্যে বিখ্যাত বইগুলো হলো- বাল্মীকির জয়, মেঘদূত ব্যাখ্যা, বেণের মেয়ে (উপন্যাস), কাঞ্চনমালা (উপন্যাস), সচিত্র রামায়ণ, প্রাচীন বাংলার গৌরব ও বৌদ্ধধর্ম। তার উল্লেখযোগ্য ইংরেজি রচনাগুলো হলো- মগধান লিটারেচার, সংস্কৃত কালচার ইন মডার্ন ইন্ডিয়া ও ডিসকভারি অফ লিভিং বুদ্ধিজম ইন বেঙ্গল।
ড. হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আমাদের জীবন্ত আদর্শ। যার জীবন ও কাজ বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির অমূল্য ধন। তাঁর অবদান চিরদিন স্মরণীয় থাকবে শুদ্ধ বাঙালির অন্তরে।