ক্লাসে উপহাসের ছাত্রটি বিজ্ঞানী আইনস্টাইন

বিপ্লব রায়।।

যদি কাউকে বলা হয়, একজন অমনোযোগী শিক্ষার্থীকে পড়িয়ে আপনি সবচেয়ে ভালো ফল অর্জন করিয়ে দিতে পারবেন? তিনি অবশ্যই বলবেন, এটা কি করে অসম্ভব? আর যদি বলা হয়, এই ছাত্রকে বিশ্বখ্যাত অধ্যাপক বানাতে হবে? তাহলে তো যে কেউ বলে বসবে, আরে এ তো সব পাগলামি কথা বলছেন হে। হ্যাঁ, আজ আমরা তেমনই একজনে কথা বলবো, যে ছাত্র সব সময় অমনোযোগী হওয়ায় তাঁর শিক্ষক তাকে ক্লাস থেকে বের করে দিয়েছিলেন। তাঁর মা’কে ডেকে বলেছিলেন, আপনার এই হাবাগোবা ছেলেকে দিয়ে কিছুই হবে না। আর সেই ছেলে কি না এক সময়ে বিশ্বের বুকে সেরা বিজ্ঞানীদের মধ্যে অন্যতম হয়েছিলেন।

পদার্থ বিদ্যায় সাফল্যের জন্য ১৯২১ সালে লাভ করেছিলেন বিশ্বের সেরা নোবেল পুরষ্কার। হ্যা, আমরা আলবার্ট আইনস্টাইনের কথা বলছি।

ছোটবেলায় খুব শান্ত ও চুপচাপ স্বভাবের হওয়ায় সবাই একটু ভিন্ন চোখে দেখতেন আলবার্ট  আইনস্টাইনকে। ক্লাসের শিক্ষক তার মাকে একদিন বলেই বসলেন, আপনার এই বোকা ছেলেকে দিয়ে কিছুই হবে না। কিন্তু তাঁর মা জানতেন, কী সস্তান তিনি গর্ভে ধারণ করেছেন। তিনিও তাদের মুখে ওপর বলে দিতেন, দেখে নিও। আমার ছেলেই একদিন অনেক বড় হয়ে বিশ্বখ্যাত অধ্যাপক হবে। মায়ের কথা সত্যি হয়েছে। আলবার্ট আইনস্টাইন বড় হয়ে অধ্যাপক শুধু অধ্যাপকই নন, কালজয়ী পদার্থ বিজ্ঞানী হয়েছিলেন।

শুরুতেই একটা মজার গল্প বলি, আইনস্টাইন ছোটবেলায় চার বছর বয়স পর্যন্ত কোন কথা বলেননি। বই পড়তে শেখেন সাত বছর বয়সে। তাই তাঁর-বাবা মা মনে মনে ভাবতেন, ছেলেটি হয়তো কখনো কথাই বলতে পারবে না। এজন্য দুশ্চিন্তার শেষ ছিল না তাদের। কিন্তু একদিন রাতে ঘটলো এক মজার ঘটনা। খাবার টেবিলে আইনস্টাইনের মা তার জন্য স্যুপ রান্না করে রাখলেন। এরপর তাকে খাবার টেবিলে ডেকে স্যুপ খেতেও দিলেন মা। কিন্তু হঠাৎ আইনস্টাইন বলে উঠলেন, মা, স্যুপটা খুব গরম। সন্তানের মুখে এমন কথা শুনে সবাই হতবাক !! তার মুখে কথা শুনে বাড়ির সবাই জিজ্ঞেস করলেন, আইনস্টাইন-তুমি এতদিন কথা বলনি কেন? তিনি জবাব দিলেন-এতদিন  তো সব ঠিকঠাক ভাবেই চলছিল!

আইনস্টাইনের জন্ম ১৮৭৯ সালের ২৪ মার্চ। জার্মানির মিউনিখ শহরে। ছেলেবেলা থেকেই খুব ধার্মিক ছিলেন তিনি। তাঁর জীবনযাপন ছিল খুবই সাদাসিধে। তাই বিজ্ঞানী তো দূরের কথা, তিনি স্বাভাবিক কিছু হতে পারবেন, এমন কথাও ভাবেননি কেউ। কিন্তু বিজ্ঞানের তাত্ত্বিক পদার্থ বিজ্ঞানে বিশেষ অবদানের জন্য পৃথিবীর সেরা নোবেল পুরষ্কারটাই যে এই আত্মভোলা ছেলেটির জন্য অপেক্ষা করছে, সে কথা কেই বা জানতো !

ছেলে বেলা থেকেই শান্তশিষ্ট আইনস্টাইন কি যেন ভাবতেন সারাক্ষণ। ক্লাসে শিক্ষকরা কোন প্রশ্ন করলে অনেক ভেবেচিন্তে উত্তর দিতেন তিনি। অন্যদের মতো হঠাৎ কোনো কিছু বলতে পারতেন না। কথা বলার সময় কিছু কথা আটকেও যেত তার। এজন্য সহপাঠীদের কাছ থেকেও কম উপহাস সইতে হয়নি আইনস্টাইনকে। যে যাই বলুক, চুপচাপ এই ছেলেটি সব কিছুতে ছিলেন খুব কৌতুহলী।

আইনস্টাইনের বাবা হেরম্যান আইনস্টাইন একবার ছেলেকে একটা কম্পাস কিনে দিলেন।  এরপর বালক আইনস্টাইন সব সময় শুধু ওই যন্ত্রটি নিয়েই থাকতেন। এক সময় হঠাৎ তাঁর মনে প্রশ্ন জাগলো, আরে! কম্পাসের এই কাঁটা শুধু একদিকেই ঘুরছে, কিছুতেই অন্যদিকে ফেরানো যায় না কেন? এবার তার বাবার কাছে এই ঘটনার কারণ জানতে চাইলেন আইনস্টাইন। বাবা তার ছেলের এমন কৌতুহল দেখে খুব খুশি হয়েছিলেন। তিনি আইনস্টাইনকে কম্পাসের কাঁটা একদিকে ঘোরার কারণ ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে বললেন।

এছাড়াও আত্মভোলা আইনস্টাইন প্রথমে সবার নজর কাড়েন একটি নিবন্ধ লিখে। তখন তাঁর বয়স কুড়ি বছর। তাঁর নিবন্ধের বিষয় ছিল আপেক্ষিকতাবাদ।

ছোটবেলায় আলোর রথে চড়ে বেড়ানোর স্বপ্ন দেখতেন ইনস্টাইন। তাই তাঁর সব ভাবনা ছিল আলো নিয়ে। যখন ক্লাসে থাকতেন, তখনও সূর্যের আলো কিংবা বাড়িতে বসে বিদ্যুতের আলো নিয়ে ভাবতে গিয়ে কম বকুনিও শুনতে হয়নি তাঁকে। তাই মাত্র ১৪ বছর বয়সেই আলোর রথে চড়ার বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি নিয়ে ভাবনা শুরু করেছিলেন আইনস্টাইন। তবে আপেক্ষিক তত্ত্ব আবিষ্কারের চিন্তাই তাকে সবচেয়ে বেশি আলোড়িত করেছে। কারণ বড় হয়েও তার মাথা থেকে আলোর রথে চড়ার এই ভূত নামাতে পারেনি কেউ। এবার আরো একটা গল্প বলি,

স্কুলের ধরাবাঁধা নিয়ম, কত্তগুলো বই পড়াশোনা। এসব মোটেও ভালো লাগত না আইনস্টাইনের। তবু মায়ের আদেশ, স্কুলে না গিয়ে উপায়ই নেই। কিন্তু সেখানে গিয়েও ক্লাসের শেষ দিকে দেয়ালের  কোণে চুপচাপ বসে থাকতেন আইনস্টাইন। একদিন সূর্যের আলো জানালার কাঁচ ভেদ করে ক্লাসের ভেতর আসছে দেখে এর কারণ বুঝতে ভাবনায় পড়ে গেলেন কিশোর আইনস্টাইন। এসময় শিক্ষক তাঁকে দাঁড়াতে বলে পড়া জিজ্ঞেস করলেন। কিন্তু তিনি ক্লাসে অমনোযোগী থাকায় উত্তর দিতে পারলেন না।

এতে শিক্ষক ক্ষিপ্ত হয়ে শাস্তি হিসেবে আইনস্টাইনকে হলরুমে গিয়ে বসে থাকার নির্দেশ দিলেন তিনি। অথচ এ যেন তাঁর শাপে বর হলো। হল রুমটা বেশ বড় ও খুব শীতল। তাই  জায়গাটা তাঁর  বেশ পছন্দ হলো। এজন্য ক্লাস থেকে বের করে দেয়ায় তিনি বরং খুশিই হলেন। কারণ সেখানেই নির্জন পরিবেশে নিজের মতো করে ভাবতে ভাবতে ক্লাসের সময় পার করে দিলেন আইনস্টাইন।  আর এই গভীর ভাবনাই ছিল তাঁর গবেষণা।

এবার আরেকটি চমকে দেওয়া গল্প বলে বিদায় নিচ্ছি, আইনস্টাইনকে একবার এক তরুণ আপেক্ষিক তত্ত্বটি সংক্ষেপে বুঝিয়ে দেওয়ার অনুরোধ করেন। এরপর তিনি বলেছিলেন, কেউ যখন কোনো সুন্দরীর সঙ্গে এক ঘন্টা গল্প করে, তখন তার ওই এক ঘন্টাকে যেন এক মিনিট মনে হবে। কিন্তু যখন তাকে কোনো গরম উনুনের কাছে নিয়ে এক মিনিট দাঁড় করিয়ে দেয়া হয়, তখন তার কাছে মনে হবে, এ যেন এক ঘন্টা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। আর এটাই হচ্ছে আপেক্ষিক তত্ত্ব।

শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেছেন, আমি মাসের পর মাস, বছরের পর বছর ধরে চিন্তা করেছি। কিন্তু সেই চিন্তাগুলো ৯৯ বারই ভুল হয়েছে। তবে শততম বারে আমি সফল হয়েছি। তিনি আরো বলতেন, স্কুলে যা শেখানো হয়, তার সবটুকুই ভুলে গিয়ে যা অবশিষ্ট থাকে তা-ই হলো আসল শিক্ষা।

জার্মান বংশোদ্ভূত মার্কিন এই পদার্থবিদ আলবার্ট আইনস্টাইনের মস্তিষ্কের গঠন নিয়ে চীনের একদল গবেষক বলেছেন, তাঁর মস্তিষ্কের গঠন অন্যদের চেয়ে ব্যতিক্রমী ছিল। আর এজন্যই তিনি এতো তুখোড় মেধার অধিকারী ছিলেন।

 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top