হযরত আমির খসরু: সংগীত জগতের এক অন্যতম নক্ষত্র

হযরত আমির খসরু
হযরত আমির খসরু। এআই দিয়ে তৈরি চিত্র

বিপ্লব রায়।।

ভারত উপমহাদেশে সংগীত জগতে হযরত আমির খসরুর নাম মহাকাশে একটি উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো। বলা হয় এই মহাগুণী আমির খসরুর হাতেই সৃষ্টি হয়েছিল সংগীত জগতের এক অন্যতম বাদ্যযন্ত্র তবলা ও সেতার। যাঁর জ্ঞানের গভীরতা কখনো পরিমাপ করার নয়। কারণ তিনি একাধারে ছিলেন মধ্যযুগে ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সঙ্গীতজ্ঞ। পাশাপাশি ছিলেন কবি, গায়ক, সুফি, দার্শনিক ও যোদ্ধা। নিজের এসব বিশেষ গুণের কারণে হযরত আামির খসরু উপাধি পেয়েছিলেন ‘তুত-ই-হিন্দ’ বা ‘ভারতের তোতা পাখি’ নামে।

আমির খসরু একইসাথে ভারতীয় এবং পারস্য কবিতা ও সংগীতে পারদর্শী ছিলেন। পারস্য সংগীতের ‘পরদা’ এবং ভারতীয় ‘রাগ’ সম্পর্কে তার গভীর জ্ঞান ছিল। তাই ভারতীয় এবং পারস্য সংগীতের সম্মিলন ঘটিয়ে নতুন সংগীত প্রকরণের সৃষ্টি করেন তিনি। অর্থাৎ দুটি পৃথক সংগীত ধারার সমন্বয় সাধিত হয় আমির খসরুর অনন্য প্রতিভায়।

তখনকার দিনে আমির খসরুর সংগীতের বিশেষ ভঙ্গিকে বলা হতো ‘কাওল’। এটি ছিল ফার্সি ও হিন্দি এই দুই ভাষায় রচিত সংগীত। কাওল সংগীত গাওয়া হতো সুফি দরবেশদের মাহফিলে এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠানে। হযরত নিজামুদ্দিন আওলিয়ার দরবারে আমির খসরু সাধারণত কাওয়ালি গজল গাইতেন। যা খুব সহজে বোধগম্য ও জনপ্রিয় ছিল। কাওয়ালি শব্দটি এসেছে আরবি ‘কাওল’ বা ‘কাওলুন’ শব্দ থেকে, যার অর্থ কথা, বাক্য। বহুবচনে শব্দটি হয়ে রূপ নিয়েছে ‘কাওয়ালি’।

তবলার আবিস্কারক হিসেবে আমির খসরুর নাম বলা হলেও এ নিয়ে একাধিক মতবাদ রয়েছে। বলা হয়- একদিন মৃদঙ্গ জাতীয় কোন দুইদিক চামড়া দিয়ে আচ্ছ্বাদিত একটি যন্ত্র ভেঙে দ্বিখণ্ডিত হয়ে যায়। কিন্ত এরপরও তা থেকে সুন্দর অওয়াজ শুনে মুগ্ধ হয়ে আমির খসরু বলেন “তব ভি বোলা”। তবলা শব্দটি “তব ভি বোলা” থেকে এসে থাকতে পারে।

এ নিয়ে ভিন্নমতও রয়েছে। যেমন- দিল্লি ঘরানার উস্তাদ সুধার খাঁ কে প্রথম তবলিয়া বলে মনে করেন। তিনি একজন বিখ্যাত পাখওয়াজ বাদক ছিলেন। কথিত আছে, ওই সময়ে ভগবান দাস নামে একজন পাখোয়াজ বাদক ছিলেন। উস্তাদ সুধার খাঁ তাঁর মতো বাদক হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শত চেষ্টার পরও ভগবান দাসের মতো হতে না পেরে ক্ষুব্ধ হয়ে নিজের পাখোয়াজ ভেঙে ফেললে দ্বিখন্ড হয়ে যায়। অনেকে মনে করেন, এখান থেকে তবলার সৃষ্টি।

মূলত: হযরত আমির খসরু ভারতীয়, ইরানী ও আরবি সঙ্গীতের মধ্যে এক অসাধারণ সম্মিলন ঘটিয়ে উত্তর ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত হিসেবে খ্যাতি পায়। তার হাত ধরেই ভারতীয় উপমহাদেশে প্রচলন হয় গজল সঙ্গীত ও কাব্যের।

আমির খসরু উদ্ভাবিত অসংখ্য সঙ্গীত ধারা এখনও উচ্চাঙ্গ সংগীতের অন্তর্ভুক্ত হয়ে আছে। শাস্ত্রীয় সংগীতে ‘তারানা’ সংগীতও আমির খসরুর নিজস্ব আবিস্কার। এটি হলো একপ্রকার শ্রুতিমধুর এবং দ্রুতগতির উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত। এর শব্দ তরঙ্গ শ্রোতাকে গম্ভীরভাবে আকর্ষণ করে- যদিও শব্দগুলো অর্থহীন।

সংগীতের অসংখ্য নতুন রাগ, তাল ও সঙ্গীত যন্ত্রও আবিস্কার করেছেন আমির খসরু। তাঁর সৃষ্ট রাগগুলোর মধ্যে রয়েছে- সাহগাড়ি, ইয়ামানি, ইসশাক, মুয়াফিক, গানাম, জিলাফ, ফারগানা, সারপর্দা, শিরুদাসত, ঘারা, মুজির,সানাম, জানগুলাহ, খেয়াল, আহমান, বাজরেখ, প্রভার্থ, নিগার, বাসিখ, সাহানা, সুবিলা ইত্যাদি।

আমির খসরু আবিষ্কৃত তালগুলোর মধ্যে ছিল- সাওয়ারি, ফিরুদাস্ত, পাহলোয়ান, জাট, পুস্ত, কাওয়ালি, আড়াবৌতালি, জালদ তিতালা, জুমড়া, সুলকাকতা, খামসাহ ইত্যাদি।

আমির খসরুর ছোটবেলা:
আমির খসরুর মা বিবি দৌলত নাজ ছিলেন সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজপুত রাওয়াত আরজের কন্যা। কিন্তু মাত্র সাত বছর বয়সে বাবাকে হারান আমির খসরু। এরপর তাঁকে চলে যেতে হয় নানার বাড়িতে। সেখানে নানা ইমাদুল মুলুকের কাছে থেকেই শুরু হয় নতুন জীবন।

মাত্র ৮ বছর বয়সেই শুরু হয় আমির খসরুর কাব্য চর্চা। চলে পড়াশোনা ও সংগীত নিয়ে গবেষণা। এভাবে আমির খসরুর বয়স ১৬ বছর ছুঁতে না ছুঁতেই প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘তুহফাতুস সিগার’।

কিন্তু বিধিবাম! আমির খসরুর বয়স যখন ২০ বছর, তখন তাঁর নানীও চলে যান পৃথিবী ছেড়ে। এসময়ে এক পর্যায়ে তিনি যোগ দেন সেনাবাহিনীতে। সেখানেও যুদ্ধবিদ্যায় বেশ পারদর্শী হয়ে সবার নজর কেড়ে নেন আমির খসরু। পাশাপাশি চলে তাঁর কাব্য চর্চা। তাঁর এই প্রতিভা দেখে তখনকার রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতায় কাব্য ও সংগীত চর্চায় গভীর মনোনিবেশের সুযোগ মেলে আমিরের। আর সেই সুযোগ তিনি হাতছাড়া করেননি। সংগীত জগতে ধীরে ধীরে আমির খসরুর নাম ছড়িয়ে পড়লে তাঁর নামের শুরুতে যুক্ত হয়ে যায় উস্তাদ।

এরপর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ১২৯০ খ্রিস্টাব্দে দিল্লি সালতানাতে খিলজি রাজবংশের শাসন প্রতিষ্ঠা হয়। সেখানে সুলতান জালালউদ্দিন ফিরোজ খিলজির সচিব পদে নিযুক্ত হন উস্তাদ আমির খসরু। তাঁর রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে মুগ্ধ হয়ে সুলতান তাকে ‘আমির খসরু’ উপাধি দেন।
এরপর জালালউদ্দিন ফিরোজ খিলজিকে নিয়ে তিনি রচনা করেন তার দ্বিতীয় মসনভি ‘মিফতাহুল ফুতুহ’।

সংগীত সম্রাট আমির খসরু একসময়ে হয়ে উঠেছিলেন ভারতের বিখ্যাত দরবেশ হযরত নিজামুদ্দিন আউলিয়ার অন্যতম ঘনিষ্ঠ শিষ্য। হযরত নিজামুদ্দিন আউলিয়া তার প্রিয় শিষ্য আমির খসরুকে এতই ভালোবাসতেন যে, তিনি ভক্তদের অসিয়ত করে যান- তার প্রিয় শিষ্য আমির খসরুর সমাধি যেন তার পাশেই দেওয়া হয়।

 

 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top