যেভাবে ঋণী করে গেলেন শিক্ষক মাহরীন চৌধুরী

শিক্ষক মাহরীন চৌধুরী
মাইলস্টোন স্কুলে বিমান দুর্ঘটনার সময় নিজের প্রাণ দিয়ে রক্ষাকারী শিক্ষক মাহরীন চৌধুরী। (ছবি-সংগৃহীত)

বিপ্লব রায়।।

রাজধানীর উত্তরায় গত ২১ জুলাই সোমবার স্কুলটির যে ভবনে বিমান বাহিনীর যুদ্ধবিমানটি বিধ্বস্ত হয়, সেদিন সেই ভবনের গেটেই দাঁড়ানো ছিলেন শিক্ষিকা মাহরীন চৌধুরী। ইচ্ছে করলে নিজের জীবন বাঁচাতে পারতেন তিনি। কিন্তু ফুলের মতো শিশুদের ফেলে কীভাবে নিজেকে রক্ষা করবেন মাহরীন? তাইতো নিজের জীবনের কথা না ভেবে একের পর এক সব শিশুকেই নিজ হাতে বের করে দিতে চেয়েছিলে মৃত্যুকূপ থেকে। কারণ, মাহরিন বিশ্বাস করতেন, স্কুলের সব শিশুই তাঁর সন্তান।

মাহরীন চৌধুরী ওই প্রতিষ্ঠানের বাংলা ভার্সনের ক্লাস টু থেকে ক্লাস ফাইভের কো-অর্ডিনেটর ছিলেন। ১৭ বছর ধরে কর্মরত ছিলেন একই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। তাই সেখানের সবার সঙ্গে ছিল তাঁর প্রাণের বন্ধন। ২১ জুলাই বিমান দুর্ঘটনার পর তিনি অন্তত ২০ জন শিশুকে নিরাপদে স্কুল গেটের দিকে সরিয়ে নিয়েছিলেন। একসময় তাঁর নিজের শরীরেও আগুন লেগে তিনি মারাত্মকভাবে দগ্ধ হন। তবুও বাকি শিশুদের রেখে তিনি সেই কক্ষ থেকে বের হননি। কীভাবেই বা বের হবেন। মা কি কখনো সন্তানদের রেখে নিজের মুক্তির কথা ভাবতে পারেন? এর মধ্যে তাঁর শরীরের প্রায় ১০০ শতাংশই পুড়ে যায়। নিজেই হয়ে পড়েন মৃত্যুপথযাত্রী। এক পর্যায়ে মাহরীন চৌধুরীকে নেওয়া হলো ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ণ ইউনিটে। ততক্ষণে তো সব শেষ!

মাহরীন চৌধুরীকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়ার আগে খুবই অল্প সময় কথা হয়েছিল স্বামী মনসুর হেলালের সঙ্গে। তিনি বলেন- শেষ রাতে হাসপাতালে ওর সঙ্গে আমার শেষ দেখা। আইসিইউতে শুয়ে শুয়ে ও আমার হাত নিজের বুকের সঙ্গে চেপে ধরেছিল। বলেছিল আমার সঙ্গে আর দেখা হবে না। আমি ওর হাত ধরতে গিয়েছিলাম, কিন্তু শরীরটা এমনভাবে পুড়ে গিয়েছিল যে ঠিকভাবে ধরতেও পারিনি।
তিনি আরও বলেন, আমি ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তুমি তোমার নিজের দুই সন্তানের কথা একবারও ভাবলে না? সে বলেছিল, ‘ওরাও তো আমার সন্তান। ওদের একা রেখে আমি কী করে চলে আসি?’

রাজধানীর উত্তরায় গত ২১ জুলাই সোমবার দুপুরে স্কুলটির যে ভবনে বিমান বাহিনীর যুদ্ধবিমানটি বিধ্বস্ত হয়, সেদিন সেই ভবনের গেটেই দাঁড়ানো ছিলেন শিক্ষিকা মাহরীন চৌধুরী। ওই সময় বেলা একটা থেকে দেড়টা পর্যন্ত পর্যায় ক্রমে স্কুলের দ্বিতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ছুটি হয়। দায়িত্ব পালনের জন্য সেখানেই ছিলেন মাহরীন। প্রতিটি শিক্ষার্থীকে প্রত্যেক অভিভাবকের হাতে বুঝিয়ে দেওয়া ছিল তার দায়িত্ব।

মাহেরিনের জন্ম ১৯৭৯ সালের ৬ জুন। তাঁদের গ্রামের বাড়ি নীলফামারীর জলঢাকা পৌর এলাকায়। প্রয়াত মহিতুর রহমান চৌধুরীর মেয়ে মাহরীন। মহিতুর রহমান চৌধুরী ছিলেন শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের খালাতো ভাই। জলঢাকার এ বাড়িতে জিয়াউর রহমান বেশ কয়েকবার এসেছিলেন। কিন্তু সেই প্রভাব তাদেরকে কখনো প্রভাবিত করেনি। পরিবারের সবাই চলেছেন সাধারণ অন্য ৫ জনের মতো।
মাহরীনের জন্ম ও বেড়ে ওঠা ঢাকায়। তবে বাবার জন্মস্থানে বারবার আসতেন তিনি।

বিএফ শাহীন স্কুল এন্ড কলেজ থেকে এসএসসি ১৯৯৫ ও এইচএসসি ১৯৯৭ সালে পাশ করেছিলেন মাহরীন চৌধুরী। এরপর তিতুমীর কলেজ থেকে ইংরেজি বিষয়ে অনার্স ও মাষ্টার্স শেষ করে ২০০২ সালে মাইলস্টোন স্কুলে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেছিলেন। কিন্তু সবাইকে ঋণী করে গত ২১ জুলাই মাইলস্টোন স্কুলে বিমান দুর্ঘটনায় শিক্ষার্থীদের প্রাণ বাঁচাতে গিয়ে নিজেই পা বাড়ালেন অনন্তের পথে।! এই মহিয়সীর প্রতি বাণীবিতান ডটকমের পক্ষ থেকে গভীর শ্রদ্ধা।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top