ডা. সামন্ত লাল সেন: বার্ন ইউনিটে দু:সময়ের কাণ্ডারি

ডা. সামন্ত লাল সেনের ছবি
ডা. সামন্ত লাল সেন-বার্ন চিকিৎসার জনক

  বিপ্লব রায়।।

বাংলাদেশে বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি চিকিৎসা জগতে যাঁকে পুরোধা ব্যক্তিত্ব বলা হয়, তিনিই হচ্ছেন অধ্যাপক ডা. সামন্ত লাল সেন। ব্যক্তি জীবনে সদালাপী, নির্মোহ ও সাদামাটা জীবনযাপনে অভ্যস্ত এই চিকিৎসক। যাঁর ধ্যানজ্ঞান যেকোনো দুর্যোগের মুহূর্তে মানুষের পাশে দাঁড়ানো। তাইতো দেশের কোথাও কোনো অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলেই বিচলিত হয়ে পড়তেন ডা. সামন্ত  লাল। কর্মঘণ্টার দিকে না তাকিয়ে আপন মনে রোগীদেরকে সেবা দিতেন এই মানুষটি। তাইতো নিয়ম মেনে সরকারি চাকরি থেকে অবসর পেলেও দায়িত্ব তাঁকে অবসর দেয়নি মোটেও।

যাঁর   প্রচেষ্টায়ই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দগ্ধ রোগিদের চিকিৎসার জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট বার্ন ইউনিট। যেখানে প্রতিনিয়ত অসংখ্য দগ্ধ রোগী চিকিৎসা নিতে আসেন।

দেশের যেকোনো দুর্বিপাকে কখনোই ঘরে চুপ থাকতে দেখায় যায়নি ডা. সামন্ত লাল সেনকে। সরাসরি কোনো রাজনীতির সঙ্গেও ছিল না তাঁর সম্পৃক্ততা। তাঁর রাজনীতি বা ধ্যান জ্ঞান একটাই, মানুষের চিকিৎসা সেবা দেওয়া। তাইতো অনেকে ভালোবেসে তাঁকে বাংলাদেশের দেবী শেঠী বলে ডাকেন। আর সেই পুরষ্কার হিসেবেই বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ৭৫ বছর বয়সে তাঁকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের। মন্ত্রী হওয়ার পর অন্য পাঁচজনের মতো অহংকারে ফেটে পড়েননি তিনি। বরং দায়িত্ব পালনের প্রাণান্ত চেষ্টা করে গেছেন এই মহান মানুষটি। তাঁর বিরুদ্ধে কোথাও কোনদিন সামান্য অভিযোগ ওঠেনি। তবুও গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর তাঁকে আত্মগোপনে যেতে হয়েছে। অথচ বাংলাদেশে বর্তমানে মাইলস্টোন স্কুল এন্ড কলেজে বিমান দুর্ঘটনায় আহতদের সুচিকিৎসার জন্য এখন তাঁর বিকল্প নেই। বহু নেটিজেন এই দু:সময়ে ডা. সামন্ত লাল সেনের কথা স্মরণ করছেন। বলছেন, রাজনৈতিক বিভেদে এই দু:সময়ে তাঁকে দূরে সরিয়ে রাখা আত্মঘাতী চিন্তা। তাঁকে ফিরিয়ে আনা যায় কি না! সেই অনুরোধ করেছেন তারা।

ফেসবুকে বহু নেটিজেন লিখেছেন, এই দু:সময়ে ডা. সামন্ত লাল সেন থাকলে আহতদের চিকিৎসা আরো ভালো হতে পারতো। তিনি ভয় মুক্ত থাকলে নিশ্চয়ই এখন নিজ উদ্যোগে ছুটে আসতেন এই অসহায়দের পাশে। নিজেই তুলে নিতেন ছোট ছোট এই শিশুদের চিকিৎসার ভার।

ডা. সামন্ত লাল সেনের জন্ম ১৯৪৯ সালের ২৪ নভেম্বর হবিগঞ্জ জেলার নাগুরা গ্রামে। পিতা জিতেন্দ্র লাল সেন ছিলেন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা। ১৯৭৩ সালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাশ করেন তিনি। ১৯৮০ সালে অস্ট্রিয়ার ভিয়েনা থেকে ‘ডিপ্লোমা ইন স্পেশালাইজড সার্জারি’ ডিগ্রি পেয়ে জার্মানি ও ইংল্যান্ডে সার্জারি বিষয়ে উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন ডা. সামন্ত লাল। এরপর দেশে ফিরে এসে ১৯৭৫ সালে দেশের প্রত্যন্ত এলাকা হবিগঞ্জের বানিয়াচং স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিকেল অফিসার হিসেবে শুরু হয় তাঁর কর্মজীবন । পাঁচ বছর পর তিনি বদলি হয়ে ঢাকায় শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যোগ দেন। সেখানে তিনি ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশের লুধিয়ানা থেকে আগত ডা. পারজেভ বেজলীল ও অধ্যাপক আর.জে. গার্স্টের ঘনিষ্ট সাহচর্য পান এবং যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসন কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেন। সেখানে মাত্র পাঁচটি বেড নিয়ে শুরু হয় পোড়া রোগী ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা।

এই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে ১৯৮৬ সালে অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহর নেতৃত্বে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্বল্প পরিসরে আগুনে পোড়া রোগীদের চিকিৎসাসেবা শুরু হয়। যেখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন ডা. সামন্ত লাল।

তাঁর প্রচেষ্টায় ২০০৩ সালে এ হাসপাতালে যাত্রা শুরু ৫০ শয্যাবিশিষ্ট স্বতন্ত্র বার্ন ইউনিট। যা পরবর্তীতে ১০০ শয্যায় উন্নীত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৯ সালের ৪ জুলাই প্রতিষ্ঠিত হয় শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট। সরকারি ব্যবস্থাপনায় পোড়া রোগীদের জন্যে বর্তমানে এটি বিশ্বের সর্ববৃহৎ চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top