
বিপ্লব রায়।।
ভারতবর্ষের সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন মাওলানা আবুল কালাম আজাদ। যাঁকে সবাই সম্মান করে মৌলানা বলে ডাকতেন। মৌলানা শব্দের অর্থ হচ্ছে- আমাদের শিক্ষক। যিনি সারাজীবন সংগ্রাম করে গেছেন একটি অসম্প্রদায়িক চেতনার সমাজ গঠন করতে। ধর্মীয় ভাবে রক্ষণশীল একটি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও তিনি হয়েছিলেন আলোরপথের এক যাত্রী। তিনি বিশ্বাস করতেন, মানুষের ভেতরে যদি মনুষ্যত্ববোধই না জন্মে, তাহলে কোনো ধর্মই সফল হবে না। মাওলানা আবুল কালাম বিশ্বাস করতেন, আগে মানুষ, তবেইতো ধর্ম। তাইতো মহাত্মা গান্ধীজী তাঁকে পিথাগোরাস, এরিস্টেটল ও প্লেটোর সঙ্গে তুলনা করতেন।
মাওলানা আবুল কালাম আজাদের আসল নাম- আবুল কালাম গুলাম মুহিউদ্দিন আহমেদ বিন খাইরুদ্দিন আল হুসেইনি আজাদ। তবে সবার কাছে তিনি মৌলানা আবুল কালাম আজাদ নামেই পরিচিত ছিলেন। আবুল কালাম আজাদের বাবার নাম মোহাম্মদ খাইরুদ্দিন। তিনি ছিলেন একজন মুসলিম পণ্ডিত। মায়ের নাম শেখ আলিয়া।
মৌলানা আজাদের কর্মজীবনও শুরু হয়েছিল সাংবাদিকতার মধ্য দিয়ে। ‘ভাকিল’ নামে এক সংবাদপত্রে তাঁর প্রথম সাংবাদিকতা শুরু হয়। যখন গোটা ভারতবর্ষ ভাগ হয়, তখন এর তুখোড় বিরোধী ছিলেন মাওলানা আবুল কালাম আজাদ। তখন তিনি বলেছেন-
“গোটা ভারতই আমার ভূখণ্ড এবং আমি এর রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক জীবন গড়ে তোলার অংশীদার- একজন মুসলমান হিসেবে আমার এই অধিকার আমি কিছুতেই বিসর্জন দিতে রাজি নই। উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পদের সব ছেড়ে দিয়ে শুধু তার একটা মাত্র টুকরো নিয়ে খুশি হওয়া- আমার কাছে নিশ্চিতভাবে সেটি কাপুরুষতা বলে মনে হয়।”
(প্রিয় পাঠক, মাওলানা আবুল কালাম আজাদ সম্পকে আরো জানতে এই লিংকে প্রবেশ করে বই সংগ্রহ করতে পারেন। )
মাওলানা আজাদ এবং জওহরলাল নেহেরু ছিলেন প্রাণপ্রিয় বন্ধু। রাজনৈতিক কোনো মতভেদ কখনোই তাদের বন্ধুত্বে চিড় ধরাতে পারেনি। যার প্রমাণ মাওলানা আবুল কালাম আজাদের আত্মজীবনী গ্রন্থটি যখন জওহর লাল নেহেরুকে উৎসর্গ করা। কারণ প্রতি লেখকের কাছে তাঁর লেখা একেকটি বই তাঁর সন্তানের মতো। সেই গ্রন্থ যখন কেউ কাউকে উৎসর্গ করে, তখন সুধীজনরা ঠিকই বুঝতে পারেন, তাদের মধ্যে বন্ধুত্বের গভীরতা কতখানি ছিল।
মহাত্মা গান্ধীর সাথে আলাপচারিতায় মাওলানা আবুল কালাম আজাদ
মাওলানা আজাদ স্বাধীন ভারতের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী নিযুক্ত হয়েছিলেন। তাঁর চিন্তাধারা এতটাই গভীর ও উদার ছিল যে, মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তাঁকে ওই পদে শ্রদ্ধার সঙ্গে রেখেছিলেন সবাই। কেউ কখনো বিরোধীতা করেনি আবুল কালাম আজাদের। যদিও বা কেউ তাঁর পদ দখলের চিন্তা করেছেন, মাওলানা আবুল কালাম আজাদের উদার চিন্তা ও কর্ম দিয়ে তাদের মাথা অনায়াসে নিচু হয়ে গেছে। কারণ তিনি কখনো কারো সংঘাতে বিশ্বাস করতেন না।
১৯৫৮ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি এই মহান নেতা এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন। তার নামে কলকাতায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। ১৯৯২ সালে তাকে ভারতের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান ভারতরত্ন (মরণোত্তর) খেতাবে ভূষিত করা হয়। স্বাধীন ভারতে শিক্ষাবিস্তারে তার উজ্জ্বল ভূমিকার কথা স্মরণে রেখে তার জন্মদিনটি সমগ্র ভারতে ‘জাতীয় শিক্ষা দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়। কতটা শ্রদ্ধার পাত্র হলে এভাবে একজন মানুষকে প্রতিটি বছর গভীর ভাবে শ্রদ্ধা করে!
মাওলানা আবুল কালাম আজাদকে যাঁরা জানেন, তাদের কাছে এই মানুষটি একটি মহাকাশের মতো। মহাকাশ কখনো কোনকিছু সংকীর্ণতা দিয়ে ভাবতে পারে না। আবুল কালাম আজাদকে তাই মহাকাশের সঙ্গে তুলনা করেন তারা।
মাওলানা আবুল কালাম আজাদের পরিবার মূলত আফগানিস্তানের হেরাত শহরের বাসিন্দা। মুঘল সম্রাট বাবরের শাসনামলে তারা ভারতে এসে প্রথমে আগ্রায় ও পরবর্তীকালে দিল্লিতে স্থায়ী হন। আজাদের পূর্বপুরুষেরা ভারতে আসার পর বিভিন্ন মুঘল সম্রাটের আমলে উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী হিসেবে নিযুক্ত হন।
আজাদের বাবার মাতামহ মাওলানা মুনাবরউদ্দীন ছিলেন ‘রুকন উল মুদাসরিন’, যা ছিল শিক্ষা বিষয়ক একটি পদবি। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের সময় আজাদের পিতা খায়েরউদ্দীন মক্কায় গিয়ে সেখানেই বসবাস করতে থাকেন। সেখানেই সম্ভ্রান্ত এক মুসলিম পরিবারের মেয়েকে বিয়ে করেন তিনি।
১৮৮৮ সালের ১১ নভেম্বর সেখানে আজাদের জন্ম হয়। তারপর ১৮৯০ সালে তার পিতা সপরিবারে কলকাতায় চলে আসেন। খায়েরউদ্দীন কলকাতায় মৃত্যুবরণ করার পর থেকে আজাদের পরিবার এখানেই থিতু হন।
ধর্মীয়ভাবে রক্ষণশীল হওয়ায় ছোটবেলায় ধর্মীয় শিক্ষা লাভের মধ্য দিয়ে শিক্ষাজীবন শুরু হয় আবুল কালাম আজাদের। তখনকার সময়ে প্রচলিত স্কুল কিংবা মাদ্রাসা শিক্ষায় খায়েরউদ্দীনের এর খুব একটা আস্থা ছিল না। তাই তিনি বাড়িতেই আজাদের শিক্ষার ব্যবস্থা করেন। বাড়িতেই আজাদ আরবি ভাষায় গণিত, জ্যামিতি, দর্শন প্রভৃতি শিক্ষালাভ করেন।
তরুণ বয়সে স্যার সৈয়দ আহমদ খানের লেখা পড়ে তিনি গভীরভাবে প্রভাবিত হন। তার চিন্তাধারায় পরিবর্তন ঘটে। তিনি আধুনিক শিক্ষার গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারেন। তাই ইংরেজী শিক্ষায় ব্রতী হন এবং অল্প সময়ের মধ্যেই নিজ প্রচেষ্টায় দক্ষতা অর্জন করেন।
সে সময়ে সমাজের প্রচলিত রীতি, পদ্ধতি আর বিশ্বাসের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারছিলেন না। একটা সময় তার ওপর পরিবারের সমস্ত শৃঙ্খল সম্পূর্ণরূপে ভেঙে পড়ে। বিদ্রোহের এক নতুন বোধে তার মন-প্রাণ ছেয়ে যায়। তখন নিজের নামের শেষে ‘আজাদ’ যুক্ত করেন, যার অর্থ মুক্ত।
মানুষকে স্বাধীনতায় উদ্বুদ্ধ করার লক্ষ্যে ‘আল হিলাল’ নামে উর্দুতে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন এই নেতা। এই পত্রিকা ব্রিটিশদের সমালোচনা করে এবং মানুষের মাঝে বিপ্লব ছড়িয়ে দিয়ে ব্রিটিশবিরোধী মনোভাব জাগিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিল। আর এতে ব্রিটিশদের বিরাগ ভাজন হওয়ায় পত্রিকাটি বন্ধ করে দেয় ব্রিটিশ শোষকরা। পরবর্তীকালে আজাদ ‘আল বালাঘ’ নামে আরো একটি পত্রিকা চালু করলে ব্রিটিশ সরকার সেটিও বাজেয়াপ্ত করে দেয়। পত্রিকা একের পর এক বন্ধ করলেও কখনোই থেমে যাননি আবুল কালাম আজাদ। অসাম্প্রদায়িক একটি দেশ গড়ার কাজে সর্বদাই নিয়োজিত ছিলেন মহৎ চিন্তার এই মানুষটি।