বিপ্লব রায়।।
যে মানুষটির বলতে গেলে মা-বাবার সান্নিধ্য তো দূরের কথা, তাদের পরিচয় জানাও দুস্কর, সেই মানুষটি কি না একজন বিশ্বসেরা প্রযুক্তিবিদ। হ্যা, ১৯৫৫ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার সান ফ্রান্সিসকো শহরে জোয়ান ক্যারোল এবং আব্দুল্লাহ ফাতাহ জান্দালির ঔরসে জন্মেছিলেন এই প্রযুক্তি স্রষ্টা। এরপর বাবা-মায়ের কাছে এই অবুঝ শিশুটির আশ্রয় না হওয়ায় দত্তক হিসেবে যেতে হয়েছিল পল ও ক্লারা জবসের ঘরে। এভাবেই ভাঙা-গড়ার জীবন নিয়ে সফল হন তিনি। আর সেই মানুষটির নাম স্টিভ পল জবস। বিশ্ববাসীর কাছে যিনি স্টিভ জবস নামেই ব্যাপক ভাবে পরিচিত।
স্টিভ জবসকে কম্পিউটার বিপ্লবের জনক বলা হয়। যে কারণে তাঁর মৃত্যুর পরও প্রযুক্তির বিশ্বে তাকে সব সময়ই স্মরণ করে। কারণ, তারা জানেন অ্যাপেলের মতো একটি সফল প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিশ্ব দরবারে দাঁড় করানোর মতো সেই অসম্ভব কাজই সম্ভব করেছিলেন স্টিভ জবস। সব বিষয়ই তিনি অনুভব করতেন গভীরভাবে। আর তাঁর পর্যবেক্ষণ থেকে তিনি বিভিন্ন উপদেশ দিয়ে সবাইকেই উৎসাহ যুগিয়েছেন প্রতিনিয়ত। তাঁর সেই উপদেশগুলোই নতুন প্রজন্মের জন্য আলোর পথ দেখিয়েছে। তারা হাটছেন নতুনের রথে। দিগ্বিজয়ের পথে।
স্টিভজবস বলতেন, কাজকে ভাল বাসুন। তবে সফলতা আসবেই। কাজের প্রতি আন্তরিক না হলে সেই কাজে কখনোই সফলতা আসে না। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলতেন- আপনার যদি পড়াশুনা করতে ভালো না লাগে, হাজার চেষ্টা করেও আপনাকে দিয়ে পড়াশোনা হবে না। ফলে পরীক্ষায় ভালো ফল অর্জনের কোনো প্রশ্নই উঠে না। আর যদি পড়তে ভালো লাগে আপনার বাসায় ১০ জন অতিথি এলেও আপনি পড়তে বসবেন, সেটা আপনার কাছে কোনো বাধাই মনে হবে না। একমাত্র কাজের প্রতি প্রচন্ড আবেগই পারে আপনাকে সফলতার প্রান্তে নিয়ে যেতে।
ইতিবাচক চিন্তা
স্টিভজবসের মতে ‘ইতিবাচক চিন্তা সফলতার মূলমন্ত্র। জীবনের খারাপ সময়গুলো সাহসের সাথে মোকাবিলা করার মূল সহায়ক হলো- ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি রাখা। কারণ, ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি, আশা ও উদ্যমতা জীবনের সবকিছুই সহজ করে তোলে। আমরা প্রতিদিন যা নিয়ে চিন্তা করি আমাদের অবচেতন মন তাই গ্রহণ করে। আর মন সে অনুযায়ী কাজ করে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আপনি যদি ভাবেন আপনি “সুখী” তাহলে আপনার অবচেতন মনও তাই মনে করবে। কিন্তু আপনি যদি ভাবেন ‘আমাকে দিয়ে কিছুই হবে না’ তাহলে আপনার অবচেতন মন তাই কমান্ড হিসেবে গ্রহণ করে সেই অনুযায়ী বাস্তবতা তৈরি করবে। তাই সবসময় ইতিবাচক চিন্তা করুন। যখন আপনি আপনার পড়াশোনা, অফিস বা অন্য কোনো ব্যাপারে কর্মদক্ষতার ঘাটতি দেখবেন তখন ইতিবাচক মনোভাব আপনার মনে মোবাইলের ১০০% চার্জের মতো কাজ করবে।
ব্যর্থতা মানেই পথের শেষ নয়
স্টিভ জবসের সম্ভবত আইকিউ মোটামুটি ১৬০ বা তার বেশি ছিল। চতুর্থ গ্রেডের শেষের দিকে চাকরির পরীক্ষা করা হয়েছিল। জবস বলেছেন: ‘আমি হাই স্কুল সোফোমোর লেভেলে স্কোর করেছি।’ এর মানে হল সে একজন চতুর্থ গ্রেডের দশম গ্রেড লেভেলে পারফর্ম করছিল।
স্টিব জবস সবাইকে স্বপ্ন দেখাতেন। বিশেষ করে হেরে যাওয়া মানুষদের। তিনি বলতেন, একটা শিশু যখন হাঁটতে শেখে, তখন কিন্তু সে বারবার পড়ে যায়, কিন্তু আবার উঠেও দাঁড়ায়। এভাবেই এক সময় সে হাঁটতে শেখে। কিন্তু সে যদি পড়ে যাওয়ার কথা চিন্তা করে বসেই থাকতো, তবে কখনোই হাঁটা হতো না তার। তাই পড়ে যাওয়া মানে শেষ হয়ে যাওয়া নয়। বরং পড়ে গিয়ে উঠে দাঁড়ানোর নামই হচ্ছে জীবন।
আমেরিকান লেখক ডেভিড শেংক তাঁর “দ্য জিনিয়াস ইন অল অব অ্যাস” বইয়ে লিখেছেন, আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে আইনস্টাইন, পিকাসো কিংবা বেটোফেনের মতো জ্ঞানী মানুষের জিন আছে। আমরা সবাই প্রতিভাবান। কিন্তু প্রকৃত প্রতিভাবানরা একটা বিষয়ে এত মনযোগ দেন, যে তার ওই জিনিসটা সক্রিয় হয়ে ওঠে।
স্টিভ জবস একবার বলেছিলেন, জীবন মাঝে মধ্যে তোমাকে ইট পাটকেল মারবে, বিশ্বাস হারিয়ে ফেলো না। আমি প্রতিটি পথে নিষ্ঠুরতার শিকার হয়ে সাফল্যের চূড়ায় আরোহন করেছিলাম। এর মধ্যেও নিজের হাতে গড়ে তোলা অ্যাপেল কোম্পানি থেকে তাকে বিতাড়িত করা হয়েছিল। তবুও কিন্তুথেমে থাকেননি তিনি। তার এই অদম্য মানসিকতাই তাকে করে তুলেছিল শেখর থেকে শেখরে। স্টিভ জবস নিজের জীবনকে উপলব্ধি করেছিলেন অন্য ভাবে।
স্টিভজবস বলেছেন, অ্যাপল থেকে চাকরিচ্যুত হওয়ার ঘটনা ছিল আমার জীবনে ঘটে যাওয়া শ্রেষ্ঠ ঘটনা। আমার জীবনের সেরা একটি সময়ে প্রবেশের পথ করে দিয়েছিল এই ঘটনাটি।
একসাথে হাজারটা জিনিসকে না বলুন
অ্যাপেল যা করেছে, তা নিয়ে যতটা গর্ববোধ করতেন জবস, ঠিক ততটাই গর্ব করতেন অ্যাপেল যেগুলো এখনো করতে পারেনি তা নিয়ে। ১৯৯৭ সালে তিনি যখন অ্যাপেলে ফিরে আসেন, তখন ৩৫০টি পণ্যসহ কোম্পানিটি গ্রহণ করেন এবং দুই বছরে পণ্যের সংখ্যা কমিয়ে ১০ এ নিয়ে আসেন। কিন্তু কেন করেছিলেন এমনটা? যাতে তিনি তার দলকে নিয়ে সব পণ্যের উপর কাজ করাতে পারেন। আমাদের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা অনেক ক্ষেত্রে ঠিক এমনই। আমরা মনে করি যে, একসাথে অনেক কাজ করা আমাদের জন্য গর্বের। আসলে মোটেও এই ধারণা ঠিক নয়। কারণ, মানুষের ব্রেন মাল্টিটাস্কিং উপযোগী নয়। মানুষের ব্রেন এক সময়ে একটা কাজেই ফোকাস করতে পারে। তাই এখন থেকে একটা সময় একটি কাজই করার পরামর্শ দেন স্টিভ জবস।
স্টিভ জবসের মতে, অনেক কিছু করার জন্য যেমন আমি গর্বিত, তেমনি অনেক কিছু না করার জন্যও আমি গর্বিত। উদ্ভাবন মানেই হলো হাজারটা জিনিসকে ‘না’ বলা।
বিশ্ব ভ্রমণ
একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ভ্রমণে মস্তিষ্কের পরিবর্তন কীভাবে আমাদের জীবনে প্রভাব ফেলে। তা বুঝতে বিজ্ঞানীরা একটি দলকে কিছুদিনের জন্য শহরের বাইরে পাঠালেন। এসময় তাদের কাছে থাকা সব ইলেকট্রনিক ডিভাইস বন্ধ করে রাখার তাদেরকে নির্দেশ দেওয়া হলো। সেখান থেকে ফিরে আসার পর তাদেরকে বেশ কিছু জটিল এবং সৃজনশীল কাজ করতে দেওয়ার পর দেখা যায়, তাদের সৃজনশীল ভাবনার ক্ষমতা বেড়েছে প্রায় ৫০ শতাংশ। তাই তিনি বলতেন, কাজ শেখা কখনোই ক্লাসরুমের চার দেয়ালের মাঝে বা বইয়ের পাতায় সীমাবদ্ধ থাকা উচিত নয়। বরং চারপাশেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অনেক কিছু যা থেকে শিক্ষা নেয়া যায়। আজকাল আমরা ঘুরতে যাই শুধু ফেইসবুকে ছবি শেয়ার করার জন্য বন্ধুরা দেখতে পাবে বলে।
ভ্রমণে মস্তিস্কের কর্মক্ষমতা বাড়ে। একটু বেশি সময় ধরে একটানা পড়াশুনা করলে দেখা যায় আমাদের মস্তিস্ক ক্লান্ত হয়ে পড়ে। তখন হাজার চেষ্টায়ও মস্তিষ্ক যেন আর কথায় শুনতে চায় না। কারণ তখন তার প্রয়োজন বিশ্রাম। তাই বিনোদনের জন্য কাছের কোনো জায়গা থেকে সবার একটু বেড়িয়ে আসা উচিত।
ঝুঁকি নিন
স্টিভ জবসের মতে, ভারা কিছু করতে হলে, ঝুঁকি আপনাকে নিতেই হবে। কারণ, আত্মবিশ্বাসী মানুষজন খুব সহজেই ঝুঁকি নিতে পারেন। নিতে পারেন দ্রæত সঠিক সিদ্ধান্তও। কারণ তারা নিজের উপর অনেক আস্থা রাখেন। এবং এই গুনটিই তাদেরকে সফল করে তোলে। স্টিভ জবস তাঁর নতুন পণ্য প্রসারের জন্য অনেক ঝুঁকি নিয়েছিলেন। তিনি আইফোন বের করার সময় অনেকে তাকে নিষেধ করছিলেন কিন্তু তিনি ঝুঁকি নিয়ে অগ্রসর হয়েছিলেন। এবং তাতে তিনি সফলও হন।
জবস বলেছিলেন, “বিভিন্ন বিষয়কে যুক্ত করাই হচ্ছে সৃজনশীলতা”। তিনি আসলে বলতে চেয়েছেন, জীবনে প্রচুর অভিজ্ঞতা সম্পন্ন একজন ব্যক্তি এমন অনেক কিছুই দেখেন এবং বুঝতে পারেন যা অন্যরা পারে না। জবস ভারত এবং এশিয়া ভ্রমণ করেছেন। তিনি ডিজাইনিং এবং আতিথেয়তা শিখেছেন। আপনি যে বিষয়ে বিশেষজ্ঞ তার বাইরের বিষয়গুলোও শিখুন। যেমন- ডিবেটিং, প্রেজেন্টেশন স্লাইড তৈরি, ইত্যাদি। আপনার এই সব বিষয়ের পারদর্শিতাই আপনাকে অন্যদের থেকে আলাদা করে তুলবে।
নেক্সটে কাজ করার সময় জবস্ বলেছিলেন, “আমি যখন বেঁচে থাকব না, তখন আমার রেখে যাওয়া সৃষ্টিশীল কাজের জন্য সবাই প্রশংসা করবে। তাই তিনি বলতেন, হাল ছেড়ো না বন্ধু।
তবে এই মানুষটি মরণঘাতী ক্যানসারের সঙ্গে দীর্ঘদিন লড়াই করে ২০১১ সালের ৫ অক্টোবর ক্যালিফোর্নিয়ায় মৃত্যুবরণ করেন। ২০০৩ সালে জবসের অগ্ন্যাশয়ের ক্যান্সার ধরা পড়ে এবং পুরো সময়কাল জুড়ে তিনি বিভিন্ন চিকিৎসা পদ্ধতির মধ্য দিয়ে গিয়েছিলেন।
প্রিয় পাঠক, এরপরের পর্বে আমরা তুলে ধরবো হাসপাতালের শয্যায় বসে স্টিভ জবসের লেখা দুর্লভ চিঠির ভাব-ভাষা। তাই যাঁরা এই লেখা পড়ে তৃপ্ত হয়েছেন, তারা চোখ রাখুন বাণীবিতান ডটকমের পাতায়। কারণ বাণীবিতান ডটকম আপনাদেরই সাহিত্য সম্ভার। – সম্পাদক।