দুপুরের রবি পড়িয়াছে ঢলে অস্ত- পথের কোলে
শ্রাবণের মেঘ ছুটে এল দলে দলে
উদাস গগন-তলে
বিশ্বের রবি, ভারতের কবি,
শ্যাম বাংলার হৃদয়ের ছবি
তুমি চলে যাবে বলে।
তব ধরিত্রী মাতার রোদন তুমি শুনেছিলে না কি,
তাই কি রোগের ছলনা করিয়া মেলিলে না আর আঁখি?
আজ বাংলার নাড়িতে নাড়িতে বেদনা উঠেছে জাগি’;
কাঁদিছে সাগর নদী অরণ্য, হে কবি, তোমার লাগি’।
তব রসায়িত রসনায় ছিল নিত্য যে বেদ-বতী
তোমার লেখনি ধরিয়াছিলেন যে মহা সরস্বতী,
তোমার ধ্যানের আসনে ছিলেন যে শিব-সুন্দর,
তোমার হৃদয় কুঞ্জে খেলিত সে মদন-মনোহর,
যেই আনন্দময়ী তব সাথে নিত্য কহিত কথা,
তাহাদের কেহ বুঝিলনা এই বঞ্চিতদের ব্যথা?
কেমন করিয়া দিয়া কেড়ে নিল তাঁদের কৃপার দান,
তুমি যে ছিলে এ বাংলার আশা প্রদীপ অনির্বাণ।
তোমার গরবে গরব করেছি, ধরারের ভেবেছি সরা;
ভুলিয়া গিয়াছি ক্লৈব্য দীনতা উপবাস ক্ষুধা জরা।
মাথার উপরে নিত্য জ্বলিতে তুমি সূর্যের মত,
তোমারি গরবে ভাবিতে পারিনিঃ আমরা ভাগ্যহত।
এত ভালোবাসিতে যে তুমি এ ভারতে ও বাংলায়,
কোন অভিমানে তাঁদের আঁধারে ফেলে রেখে গেলে,
হায়।
বল- দর্পীর মাথার উপরে চরণ রাখিয়া আর
রক্ষা করিবে কে এই দুর্বলের সে অহংকার?
হের, অরণ-কুন্তল এলাইয়া বাংলা যে কাঁদে,
কৃষ্ণা- তিথির অঞ্চলে মুখ লুকায়েছে আজ চাঁদে।
শ্রাবণ মেঘের আড়াল টানিয়া গগনে কাঁদিছে রবি,
ঘরে ঘরে কাঁদে নর-নারী, “ফিরে এস আমাদের কবি।”
ভারত- ভাগ্য জ্বলিছে শ্মশানে, তব দেহ নয়, হায়।
আজ বাংলার লক্ষ্মীশ্রীর সিঁদুর মূছিয়া যায়।
আজ প্রাচ্যের কাব্যছন্দ সুরের সরস্বতী
তোমার শ্মশান- শিখায় দগ্ধ করিল চাঁদের জ্যোতি।
এত আত্মীয় ছিলে তুমি বুঝি, আগে বুঝে নাই কেহ;
পথে পথে আজ লুটাইছে কোটি অশ্রু-সিক্ত দেহ।
যেই রস-লোক হতে এসেছিলে খেলিতে এ পৃথিবীতে,
সেথা গিয়া তুমি মোদেরে স্মরিয়া কাঁদিবে না কি নিভৃতে?
তোমার বাণীর সুরের অধিক প্রিয়তম ছিলে তুমি,
বাংলার শ্রীর চেয়ে ভালোবেসেছিলে বঙ্গভূমি।
আশ্বাস দাও, হে পরম প্রিয় কবি, আমাদের প্রাণে
ফিরিয়া আসিবে নবরুপ লয়ে আবার মোদের টানে।
এত রস পেয়ে নীরস শীর্ণ ক্ষুধিত তরে
কেন কেঁদেছিলে, কেন কাঁদাইলে আজীবন প্রেম ভরে।
শুনেছি, সূর্য নিভে গেলে হয় সৌরলোকের লয়;
বাংলার রবি নিভে গেল আজ, আর কাহারও নয়।
বাঙ্গালি ছাড়া কি হারালো বাঙালি, কেহ বুঝিবেনা আর,
বাংলা ছাড়া এ পৃথিবীতে এত উঠিবে না হাহাকার।
মোদের আশার রবি চলে গেলে নিরাশা-আঁধারে ফেলে,
বাংলার বুকে নিত্য তোমার শ্মশানের চিতা জ্বেলে।
ভূ-ভারত জুড়ে হিংসা করেছে এই বাংলার তরে-
আকাশের রবি কেমনে আসিল বাংলার কুঁড়ে ঘরে।
এত বড়, এত মহৎ বিশ্ববিজয়ী মহা-মানব
বাংলা দীন হীন আঙ্গিনায় এত পরমোৎসব
স্বপ্নেও আর পাইব কি মোরা? তাই আজি অসহায়
বাংলার নরনারী, কবি-গুরু, শান্ত্বনা নাহি পায়।
আমরা তোমারে ভেবেছি শ্রীভগবানের আশীর্বাদ,
সে আশিস যে লয় নাহি করে মৃত্যর অবসাদ।
বিদায়ের বেলা চুম্বন লয়ে যাও তব শ্রীচরণে,
যে লোকেই থাক হতভাগ্য এ জাতিরে রাখিও মনে।
Pingback: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অজানা তথ্য | www.banibitan.com