ইলা মজুমদার: প্রথম বাঙালি নারী প্রকৌশলী

ইলা ঘোষ মজুমদার
ইলা মজুমদার: প্রথম বাঙালি নারী প্রকৌশলী

 বিপ্লব রায়।।

ইলা ঘোষ মজুমদার। শত সংগ্রাম করে যিনি ইতিহাসে নাম লিখিয়েছিলেন প্রথম বাঙালি নারী প্রকৌশলী হিসেবে। তাঁর আদি বাড়িও বাংলাদেশের মাদারীপুর জেলায়।

১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের আগে নারীদের জন্য প্রকৌশল বিদ্যায় পড়াশোনা করা বেশ কঠিন ছিল। কারণ সাহস করে কেউ তখন এই পড়াশোনায় আসতেন না। কিন্তু একদিন ঠিকই পশ্চিমবাংলার বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হতে এলেন সুন্দরী চঞ্চলা এক তরুণী। নাম তাঁর ইলা জুমদার। তাঁর সঙ্গে অজন্তা গুহ নামে আরো এক নারী সহপাঠী ছিলেন ঠিকই। কিন্তু তিনি পাঠ না চুকিয়েই অর্থাৎ দ্বিতীয় বর্ষের মাথায় প্রকৌশল বিদ্যার পড়াশোনা ছাড়লেন। তবুও থেমে যাননি ইলা। কারণ তাঁর বাবা ছিলেন তীক্ষ্ণ দূরদৃষ্টি সম্পন্ন ও প্রগতিশীল।

ইলা ঘোষ মজুমদার নাম হলেও তাকে সবাই ইলা মজুমদার বলেই ডাকতেন। সবার কাছে পরিচিতি ছিলেন ইলা মজুমদার নামেই। কারণ বিয়ের পর ইলার নামের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল ঘোষ উপাধি। তাঁর জন্ম ১৯৩০ সালের ২৪ জুলাই। বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলার মাদারীপুর নামের একটি গ্রামে।

ইলার বাবা যতীন্দ্র কুমার মজুমদার ছিলেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। মা ছিলেন গৃহবধূ। দুজনই ছিলেন মুক্ত চিন্তার ও প্রগতিশীল মানুষ। তাই ছোটবেলা থেকেই একমাত্র মেয়েকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েই মানুষ করেছেন তারা। তাইতো ১২ বছর বয়সেই রপ্ত করেছিলেন বাইসাইকেল চালানো। ওই সময়ে মেয়েদের বাইসাইকেল চালানো সত্যি খুব কঠিন ব্যাপার ছিল। এরপর জিপ চালানো।শিখেছিলেন ১৬ বছর বয়সে।
খুলনায় নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছিলেন ইলা মজুমদার। কিন্তু বিধি বাম! তখন সাম্প্রদায়িক সংকট বেড়ে যাওয়ায় বাধ্য হয়ে পূর্ববঙ্গের পাঠ শেষ হয়ে যায় মজুমদার পরিবারের।

দেশভাগের আগেই মাত্র ১৬ বছর বয়সে ১৯৪৫ সালে পরিবারের সঙ্গে কলকাতায় চলে যান ইলা মজুমদার। সেখানে গিয়ে মেট্টিক পাশ করার পর ডাক্তারি পড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন ইলা। কিন্তু তার মন যে কল কবজার বাঁধনে আটকা পড়েছে অনেক আগেই। তাইতো মেডিকেলের পড়া বাদ দিয়ে যুক্ত হলেন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে। কিন্তু এই কাজে প্রচন্ড শারীরিক পরিশ্রম দরকার বলে অধ্যক্ষ তাকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে নিষেধ করেন। তাই এক পর্যায়ে ইলা ভর্তি হন মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে।

এরপর আর থেমে থাকেননি ইলা মজুমদার। ১৯৫১ সালে প্রকৌশল বিদ্যায় পাশ করে হয়ে যান বাংলার প্রথম মহিলা প্রকৌশলী। নাম লেখালেন ইতিহাসের পাতায়। কলেজে ছাত্রদের মধ্যে ইলা মজুমদারই ছিলেন একমাত্র ছাত্রী। যদিও প্রথম দিকে এ নিয়ে বেশ খারাপ লাগতো তার। তবে ধীরে ধীরে সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে যায়।

সমস্যা ছিল কলেজে থাকা নিয়ে। কারণ সেখানে ছেলেদের হোস্টেল থাকলেও মেয়েদের জন্য থাকার ব্যবস্থা ছিল না। তাই ইলা মজুমদারের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল লাইব্রেরি সংলগ্ন একটি ঘরে। সেখানে তাঁর অভিভাবক ছিলেন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের বিভাগীয় প্রধান পুলিন বিহারী ঘোষ। পিতৃ স্নেহে ইলাকে পড়াশোনায় উৎসাহ দিতেন তিনি।

১৯৫১ সালে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করার পর উন্নত প্রশিক্ষণের জন্য স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো যান ইলা। ট্রেনিং শেষে ভারতে ফিরে যোগ দেন দেরাদুনের অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরিতে। ইলা মজুমদার ভারতের প্রথম মহিলা যিনি ভারী যন্ত্রাংশ তৈরীর কারখানায় কাজ করেছেন। ছয় মাস চাকরি করার পর দিল্লি পলিটেকনিক কলেজে অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন মহিয়সী এই নারী। পরবর্তীতে কলকাতার ইনস্টিটিউট অফ জুট টেকনোলজিতে লেকচারার হয়েছিলেন তিনি। পেশাগতক্ষেত্রে লিঙ্গবৈষম্যের সম্মুখীন হতে হয়েছিল ইলাকে। শুধু তাই নয়, কর্তৃপক্ষ নানা ছলে বাধ সেধেছিল তাঁর পদোন্নতিতে। তবুও কোথাও থেমে যাননি এই বিদুষী।

কলকাতার প্রথম মহিলা পলিটেকনিক কলেজের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রথম অধ্যক্ষ ছিলেন ইলা মজুমদার। তার কাজে মুগ্ধ হয়ে ১৯৮৫ সালে জাতিসংঘ থেকে তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয় ঢাকা শহরে একটি মহিলা পলিটেকনিক কলেজ চালু করার। সেই সময় পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাঁকে ছাড়তে রাজি হয়নি। কিন্তু মাতৃভূমির টান ফেরাতে পারেননি ইলা। পরে ঢাকা এসে কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি। ২০১৯ সালে ৯০ বছর বয়সে প্রয়াণ ঘটে ইলা ঘোষ মজুমদারের।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top