রতন থিয়াম: ভারতীয় মঞ্চনাটকের অন্যতম পথিকৃৎ

রতন থিয়াম ভারতীয় মঞ্চনাটকের কিংবদন্তি ও থিয়েটার অব রুটস আন্দোলনের পথিকৃৎ
রতন থিয়াম – ভারতীয় মঞ্চনাটকের অন্যতম পথিকৃৎ

বিপ্লব রায়।।

ভারতীয় মঞ্চনাটকের অন্যতম পথিকৃৎ যাঁকে বলা হয়, তিনি রতন থিয়াম। যাঁকে শ্রদ্ধা করে ভক্ত অনুরাগীরা ডাকতেন ‘থিয়েটার অব রুটস’ আন্দোলনের পথিকৃৎ হিসেবে।

জন্মের পর নেমাই নামেই পরিচিত ছিলেন রতন। বড় হয়ে পরিচিতি লাভ করেন রতন থিয়াম নামে। গুণী এই ব্যক্তির নির্দেশনায় থিয়েটারে স্থান পায় লোকসংস্কৃতি, আধ্যাত্মিক চিন্তা ও দর্শন এবং প্রথা ভেঙে নতুন কিছু সৃষ্টির দৃষ্টিভঙ্গি। রতন থিয়ামের সৃজনশীলতাকে ভারতীয় নাট্যজনরা নাম দিয়েছিলেন- পঞ্চম বেদ। তাঁর ভক্তরা বলেন- তাঁর লেখা নাটকে যেন শেকড়ের সুগন্ধি থাকে।

জীবনে পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় ধরে বিশেষ নাট্যশৈলীর মাধ্যমে মানুষের অভিজ্ঞতা পরীক্ষা করার জন্য নিবেদিত ছিলেন রতন থিয়াম। যিনি আত্মায় ধারণ করেছিলেন নাটক ও শিল্প সংস্কৃতিকে। তাঁর নাট্যকর্ম ও অনিন্দ্য সুন্দর সৃষ্টি শুধু মনিপুর নয়, গোটা ভারত এবং বিশ্বজুড়ে কোটি দর্শকের হৃদয় কেড়েছে অনায়াসে। ভূয়সী প্রশংসায় ভূষিত হয়েছেন রতন।

হিন্দুশাস্ত্র মহাভারতে কর্ণের মানসিক টানাপোড়েন নিয়ে লেখা ‘কারানাভারাম’, ‘ইম্ফল ইম্ফল’, চক্রব্যুহ ও কালিদাস অবলম্বনে ‘ঋতুসমহরম’ , রবীন্দ্রনাথের ‘রাজা ‘ অনুসরণে দ্য কিং অফ ডার্ক চেম্বার নাটক প্রযোজনা করে দর্শকদের হৃদয়ের মণি হয়েছিলেন তিনি। দর্শকরা বলতেন, রতনের স্পর্শ ছাড়া নাটক কখনো পূর্ণতা পায়নি।

“সভ্যতা, সংস্কৃতি বলতে আমরা কী বুঝি? কোট-প্যান্ট পরা, মুঠোফোন হাতে ঘোরা? একেবারেই নয়। এসব তো আর্টিফিশিয়াল জিনিস, নকল। সভ্যতা-সংস্কৃতির সঙ্গে এসবের সম্পর্ক নেই। বরং এসবের মধ্যে থেকে আমরা সত্যিকারের সভ্যতা থেকে অনেক দূরে চলে যাচ্ছি। শিকড়ে ফেরার জন্যই আদিবাসী সংস্কৃতিকে জানা দরকার- রতন থিয়াম। ”                                                     

বিখ্যাত এই সংস্কৃতিসেবী বলতেন- “সভ্যতা, সংস্কৃতি বলতে আমরা কী বুঝি? কোট-প্যান্ট পরা, মুঠোফোন হাতে ঘোরা? একেবারেই নয়। এসব তো আর্টিফিশিয়াল জিনিস, নকল। সভ্যতা-সংস্কৃতির সঙ্গে এসবের সম্পর্ক নেই। বরং এসবের মধ্যে থেকে আমরা সত্যিকারের সভ্যতা থেকে অনেক দূরে চলে যাচ্ছি। শিকড়ে ফেরার জন্যই আদিবাসী সংস্কৃতিকে জানা দরকার। ”

২০১৫ সালে প্রথম আলোতে প্রকাশিত শুভাশিস সিনহার গ্রহণ করা এক সাক্ষাৎকারে রতন থিয়াম আরও বলেছিলেন, ‘নাটক করতে গেলে স্বার্থ ত্যাগ করতে হয়। স্যাক্রিফাইস…প্রথমেই জানতে হবে যে মঞ্চনাটকে কোনো স্টার ইমেজ নেই। যে যতই ভালো পারফরম্যান্স করুক না কেন, কোনো স্টার ইমেজ নেই, পপুলারিটি নেই, টাকা-পয়সা আসবে না। অর্থাৎ এখানে কোনো ইন্ডাস্ট্রি নেই। নাটক হচ্ছে এমন একটা জিনিস, যেখানে সৌন্দর্যবোধ বা নান্দনিকতার খোঁজে অনেক কলা বা ক্র্যাফটকে জড়ো করা হয়।’

তাঁর অন্যতম সেরা প্রযোজনা ম্যাকবেথ মঞ্চস্থ হয়েছিল কোলকাতাতেও। থিয়ামের দর্শনে ‘ম্যাকবেথ’ একটা রোগ এর নামান্তর। রতন থিয়াম শুধু নাটকেরই স্রষ্টা ছিলেন না। তিনি ছিলেন একাধারে বিখ্যাত চিত্রশিল্পী এবং সঙ্গীতজ্ঞ। সমকালের নাট্যদর্শনের আঁচে তিনি যে আলোকচ্ছটা ছড়িয়েছেন মঞ্চে, তার সৃষ্টির সেই নৈপুণ্যের কথা কোনোদিন ভুলতে পারবেন না কেউ। ভারতের জাতীয় নাট্যবিদ্যালয়ের (ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামা, এনএসডি) চেয়ারম্যানও ছিলেন রতন থিয়াম।

মণিপুরি ভাষায় বহু কবিতাও লিখেছেন গুণী এই মানুষটি। যা প্রকাশিত হয়েছে তাঁর দুটি কাব্যগ্রন্থে। যার নাম—‘তালাপামেল নাহাকসু’ ও ‘সনাগী থম্বাল’। সেখান থেকে নির্বাচিত ২০৫টি কবিতা বাংলায় অনুবাদ করে প্রকাশিত হয়েছে। সেসব কবিতায় উঠে এসেছে যুদ্ধ, সহিংসতা, আদিবাসী জীবনের টানাপোড়েন ও অস্তিত্ববাদী প্রশ্ন।

১৯৮৪ সালের ২০ জানুয়ারি ভারতের মনিপুর রাজ্যে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। ছোটবেলা থেকেই রতন থিয়াম ছিলেন নাটক লেখা ও অভিনয়ে পারদর্শী। পড়াশোনাও করেছেন এই নাটকের ওপরেই। সেই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৪ সালে দিল্লির ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামা থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেন রতন। জীবদ্দশায় অর্জন করেছেন দেশি-বিদেশি বহু পুরস্কার ও সম্মাননা। এর মধ্যে সঙ্গীত নাটক একাডেমি পুরস্কার, সঙ্গীত নাটক আকাদেমি পুরস্কার, কালিদাস সম্মান, ভারত মুনি সম্মান, ভূপেন হাজারিকা ফাউন্ডেশন পুরস্কার এবং ১৯৮৯ সালে পদ্মভূষণ অন্যতম।

পারিবারিকভাবেই শিল্প ও শিল্পকর্মের মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠেছিলেন রতন থিয়াম। তাঁর বাবার থিয়াম তরুণকুমার ছিলেন একজন স্বর্ণকার। পাশাপাশি ছিলেন ধ্রুপদি মণিপুরী নৃত্যের স্বনামধন্য গুরু। তার মা বিলাসিনী দেবী ছিলেন একজন প্রখ্যাত নৃত্যশিল্পী।

উপমহাদেশে কিংবদন্তিতুল্য, কিন্তু আচারে স্বভাবে শান্ত, সৌম্য, ধ্যানী ও গুণী এক শিল্পী ছিলেন রতন থিয়াম। ৭৭ বছর বয়সে গত ২৩ জুলাই পার্থিব মায়া ত্যাগ করে অনন্তের পথে পাড়ি জমান গুণী এই শিল্পী। তাঁর প্রতি আমাদের গভীর শ্রদ্ধা।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top