রবীন্দ্রনাথের যত গোপন কথা!

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গোপন প্রেম ও জীবন কাহিনী
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

 

বিপ্লব রায়।।

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রথম প্রেম হয়েছিল তাঁর ১৭ বছর বয়সে। মারাঠী মেয়ে অনিন্দ্য সুন্দরী নলিনীর সঙ্গে। সবাই কি সেই খবর জানি? যাঁরা না জানি, তাদেরকে  সেই খবরই জানাবো আজ।

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মোহনীয় গানে সবাই মন্ত্রমুগ্ধ হলেও তাঁর ব্যক্তিগত জীবন ও সৃষ্টি সম্পর্কে অনেক তথ্যই অনেকের অজানা। তাঁর গান ও কবিতায় আমরা এতোই মুগ্ধ যে তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের অন্য কিছু জানার কথা মাথায়ই আসে না। কারণ, রবীন্দ্রনাথ হচ্ছেন বিশ্বসাহিত্য ও সংগীত জগতে এমন এক মহাসমুদ্রের নাম। যাকে ঘরে আনা যায় না। শুধু তাঁর তীরে ঘুরে বেড়ানো যায়।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে বলা হয় প্রেমের কবি। তাঁর অসংখ্য কবিতা ও গানের প্রতিটি শব্দে লুকিয়ে আছে প্রেম, বিরহ, ব্যাকুলতা আর নিঃসঙ্গতার মহাউপাখ্যান। কখনো একা নীরবে-নিভৃতে বসে যদি তার কোনো কবিতা কেউ পড়েও থাকেন, সেগুলো কীভাবে যে কারো জায়গা জুগিয়ে নেয় মনের গহীনে, কেউ বুঝতেই পারে না। তাই গুনগুন করে কখনো মনের মধ্যে বেজে ওঠে- আহা! তোমার সঙ্গে প্রাণের খেলা……!

রবীন্দ্রনাথের ছদ্মনাম ভানুসিংহ ঠাকুর। কিন্তু তাঁর আরো বেশ কয়েকটি ছদ্মনাম ছিল। যেমন দিকশূন্য ভট্টাচার্য, অপ্রকটচন্দ্র ভাস্কর, আন্নাকালী ও পাকড়াশি ইত্যাদি। তাঁর জন্ম বাংলা ১২৬৮ সালের ২৫শে বৈশাখ। ইংরেজি ১৮৬১ সালের ৭ মে। কোলকাতার জোড়াসাঁকোর ব্রাহ্ম পিরালী ব্রাহ্মণ পরিবারে। তাঁর বাবার নাম মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। মা- ছিলেন সারদা সুন্দরী দেবী।

রবীন্দ্রনাথ ছিলেন তাঁর পিতা-মাতার চতুর্দশ সন্তান। তাঁর পূর্ব পুরুষেরা এক সময়ে খুলনার রূপসা উপজেলার পিঠাভোগ গ্রামে বাস করতেন। সেই গ্রামে এখনো কবিগুরুর পূর্ব পুরুষদের ভিটাবাড়ির চিহ্ন রয়ে গেছে।

কথার মধ্যে একটু জানিয়ে নিচ্ছি রবীন্দ্রনাথের প্রথম প্রেম ও প্রেমিকা সম্পর্কে। বোম্বে থাকার সময় কবির প্রথম প্রেম হয়েছিল ১৭ বছরের কিশোর বয়সে। মারাঠী মেয়ে অনিন্দ্য সুন্দরী নলিনীর সঙ্গে। তবে এ নামটি তাঁর আসল নাম নয়। তাঁর আসল নাম ছিল অন্নপূর্ণা তড়খড়। কিন্তু তিনি ছিলেন রবীর চেয়ে তিন বছরের বড়। কবি ভালোবেসে অন্নপূর্ণার নাম রেখেছিলেন নলিনী। তবে কবি পরিবারের আপত্তির মুখে শেষমেষ সেই প্রেম আর প্রণয়ে গড়ায়নি।

কিন্তু প্রথম যৌবনের সন্ধিক্ষণে দেখা রবীন্দ্রনাথের প্রতি ভালোবাসা শেষ দিন পর্যন্তই হৃদয়ে ধারণ করেছেন মারাঠী কন্যা আন্না।

এই প্রেমের প্রমাণ মেলে রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন সাহিত্যকর্মে। তাকে নিয়ে কবি ফুটিয়ে তুলেছেন তাদের ভালোবাসা আর বিরহের নীরব গল্প। ১৮৮৪ সালে ‘নলীনি’ নামে একটি গদ্য নাটক রচনাও করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ।

এরপর কালের পরিবর্তনে ১৮৮৩ সালে রবীন্দ্রনাথের বিবাহ হয় ঠাকুরবাড়ির কর্মচারী বেণীমাধব রায় চৌধুরীর মেয়ে ভবতারিণীর সঙ্গে। বিয়ের পর ভবতারিণীর নামটি পছন্দ ছিল না কবির। তাই পরিবর্তন করে রাখা হয়েছিল মৃণালিনী দেবী।

তাদের সন্তান ছিলেন পাঁচজন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন মাধুরীলতা, রথীন্দ্রনাথ, রেণুকা, মীরা এবং শমীন্দ্রনাথ। এঁদের মধ্যে অতি অল্প বয়সেই রেণুকা ও শমীন্দ্রনাথের মৃত্যু হয়।

আট বছর বয়সে কবিতা লেখা শুরু করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ১৮৭৪ সালে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় তাঁর “অভিলাষ” কবিতাটি প্রথম প্রকাশিত হয়। এছাড়া মোট প্রকাশিত হয় তাঁর ৫২টি কাব্যগ্রন্থ, ৯৫টি ছোটগল্প, ৩৮টি নাটক, ১৩টি উপন্যাস ও ১৯১৫টি গান (বাকীটা এখনো পাওয়া যায়নি)। ছবি এঁকেছিলেন প্রায় দুই হাজার।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রথম বই ‘কবি কাহিনী’ প্রকাশিত হয় কবির অজান্তে। ১৮৭৮ সালের ৫ নভেম্বর। কবি তখন বিলেতে ছিলেন। কবিবন্ধু প্রবোধচন্দ্র ঘোষ বইটি প্রকাশ করে কবির কাছে পাঠিয়েছিলেন। চির বিদায়ের আগ পর্যন্ত তাঁর মোট ৩১১টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের প্রথম গানের সংকলন প্রকাশিত হয় ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে। এছাড়া ‘গীতবিতান’ প্রকাশিত হয় ১৯৩১ সালে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রথম অভিনয়ের অভিষেক হয় ১৮৭৭ সালে। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘এমন কর্ম আর করব’ না নাটকে। তখন তার বয়স মাত্র ১৬। নিজের লেখা নাটকে রবীন্দ্রনাথ প্রথম অভিনয় করেন ‘বাল্মিকী প্রতিভা’য় বাল্মিকীর চরিত্রে। নাটকটি হয় জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়িতে মঞ্চস্থ হয় ১৮৮১ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি। তার অভিনয় দেখে নাট্যাচার্য শিশিরকুমার ভাঁদুড়ি বলেছিলেন, ‘রবীন্দ্রনাথই দেশের শ্রেষ্ঠ অভিনেতা।

বাংলাদেশ ও ভারতের পাশাপাশি শ্রীলঙ্কার জাতীয় সংগীতও রচনা করেছেন রবীন্দ্রনাথ। এছাড়া মোহনদাস করম চাঁদ গান্ধীজীকে যে ‘মহাত্মা’ নামে আমরা ডাকি, সে নামটিও তাঁরই দেওয়া।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাড়িতে থাকার সময় পরতেন গেরুয়া বা সাদা রঙের জোব্বা আর পাজামা। উপাসনা বা সভা-সমিতিতে গেলে জোব্বা ছাড়াও পরতেন সাদা ধূতি, জামা ও চাদর। ঋতু উৎসবে ঋতু অনুযায়ী নানা রঙের রেশমী উত্তরীয় ব্যবহার করতেন কবি। যেমন বর্ষায় কালো বা লাল, শরতে সোনালি আর বসন্তে বাসন্তী রঙ। কখনো কখনো জোব্বার রঙের সঙ্গে মিলিয়ে উত্তরীয় পরতেন কবি।

১৮৯০ সাল থেকে পূর্ববঙ্গের শিলাইদহের জমিদারি এস্টেটে বসবাস শুরু করেন রবীন্দ্রনাথ। কুঠিবাড়িতে দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করেছিলেন কবি। এছাড়া শিলাইদহে “পদ্মা” নামে একটি পারিবারিক বজরায় চড়ে খাজনাও আদায় করতেন জমিদার রবীন্দ্রনাথ।

১৯০১ সালে তিনি পশ্চিমবঙ্গের শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। পরে সেখানেই পাকাপাকিভাবে বসবাস শুরু করেন কবিগুরু। নোবেল পান ১৯১৩ সালের ১৩ নভেম্বর। ১৯১৯ সালের ১৩ এপ্রিল ৩১ মে ব্রিটিশদের দেওয়া ‘নাইট’ উপাধি বর্জন করেন তিনি।

কিন্তু প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে একদিন জীবনের চাকা থেমে যায় রবীন্দ্রনাথেরও। বাংলা ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের ২২ শ্রাবণ মহাপ্রয়াণ ঘটে এই কবিগুরুর। সেদিন ইংরেজি তারিখ ছিল ১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট। আর সেদিন সবচেয়ে বেশি ব্যথিত হয়েছিলেন দ্রোহের কবি কাজী নজরুল ইসলাম। কবি গুরুর মৃত্যুতে তিনি রচনা করেছিলেন-‘রবিহারা’ কবিতাখানি। এতে তিনি লিখেছিলেন-

দুপুরের রবি পড়িয়াছে ঢলে, অস্তপথের কোলে
শ্রাবণের মেঘ ছুটে এলো দলে দলে
উদাস গগণ তলে,
বিশ্বের রবি, ভারতের কবি
শ্যাম বাংলার হৃদয়ের ছবি
তুমি চলে যাবে বলে……..(সংক্ষেপিত)

প্রিয় বন্ধুগণ! সত্যি বলতে, কবিগুরুর বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের সংক্ষেপ করা অসম্ভব। তাঁকে জানতে হলে ডুবতে হবে রবীন্দ্র মহাকাব্যে। এই মহামানবের প্রতি আমাদের অশেষ শ্রদ্ধা।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top