এম জসীম উদদীন।।
হেমন্ত ছিল প্রকৃতি প্রেমিক কবি জীবনানন্দ দাশের প্রিয় ঋতু। তাই এই হেমন্তদিনেই নির্ভৃতচারী কবি তাঁর জাগতিক সমস্ত শিল্প প্রচেষ্টার যবনিকা টেনেছিলেন কিছু শেষ করে, কিছু অসমাপ্ত আর বেশির ভাগ অপ্রকাশিত রেখে। ১৯৫৪ সালের ১৪ অক্টোবর কলকাতার বালিগঞ্জে ট্রাম দুর্ঘটনার শিকার হন। হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে ২২ অক্টোবর পাড়ি দিয়েছিলেন অনন্তলোকে। যে অনন্তলোকের পেছনে তিনি জীবদ্দশায় প্রতিদিন ছুটতেন, গন্তব্যহীন হাটতেন, দৃশ্যের বাইরের জগতকে অবলোকনের খিদেয়। জীবনকে তিনি স্পর্শ করতে চেয়েছিলেন, তা পেরেছিলেনও বোধকরি। আমরা তাঁর সৃষ্টিকর্মে সেই স্পর্শেন্দ্রিয়ময় এক আলাদা ইন্দ্রীয়ের সত্ত্বা দেখি। কবিতায় সেই ছাপও দেখা যায়। ‘ধূসর পাণ্ডুলিপির’ পিপাসার গান -কবিতায় সেই দৃশ্যকল্প এভাবে এঁকেছিলেন তিনি-
হেমন্তের রৌদ্রের মতন
ফসলের স্তন
আঙুলে নিঙাড়ি
এক ক্ষেত ছাড়ি
অন্য ক্ষেতে
চলিবে কি ভেসে
এ সবুজ দেশে
আর এক বার!
শুধু তাই নয়, কবি হাজার বছর আগের এক চেনা সত্ত্বার ভেতরেও যেন অবগাহন করছিলেন। কবিতায় তার প্রকাশ দেখা যায়। ‘নগ্ন নির্জন হাত’ কবিতায়, এভাবেই তিনি তা ব্যক্ত করেছিলেন-
‘মনে হয় কোনো বিলুপ্ত নগরীর কথা
সেই নগরীর এক ধূসর প্রাসাদের রূপ জাগে হৃদয়ে’।
কিংবা ‘আমি যদি হতাম, বনলতা সেন’ কবিতায় তিনি সেই পুরনো চেনা সত্ত্বায় অবগাহন করেছেন পুনশ্চ;
‘আকাশের রূপালি শস্যের ভেতর গা ভাসিয়ে দিতাম
তোমার পাখনায় আমার পালক,
আমার পাখনায় তোমার রক্তের স্পন্দন-
নীল আকাশে খই ক্ষেতের সোনালী ফুলের মতো অজস্র তারা। কিংবা
আরেক কবিতায় এভাবে সেই পুরনোতে অবগাহন করে করে উচ্চারণ করেছেন আক্ষেপ-
‘চোখে তার
যেন শত শতাব্দীর নীল অন্ধকার;
স্তন তার
করুণ শঙ্খের মতো- দুধে আর্দ্র- কবেকার শঙ্খিনীমালার;
এ-পৃথিবী একবার পায় তারে, পায় নাকো আর।’
জীবনের পথে হাটতে হাটতে প্রগাঢ় ইন্দ্রিয়চেতনা তাঁকে পরাবাস্তবতার নিগূঢ় জগতে পৌঁছে দিয়েছিল। যে জগৎকে তিনি এভাবে অকপটে বর্ণনা করেছিলেন- “হাজার পথ ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে।” সেই নির্জনতার কবি, প্রকৃতি-প্রেমের কবি জীবনানন্দ দাশ। তোমায় শ্রদ্ধা।