
বিপ্লব রায়।।
অন্তত তিন দশক আগে বাংলাদেশে যে পত্রিকাগুলো প্রকাশিত হতো, তাতে গণমানুষের কথাই লেখা হতো। তাদের জীবন-জীবিকা, ভালো-মন্দ সবকিছু লিখতেন সাংবাদিকরা। আশির দশকের বিখ্যাত চারণ সাংবাদিক মোনাজাত উদ্দিনের ইতিহাস পড়লে সেই যুগের সাংবাদিকতার স্পষ্ট ধারণা মেলে। ওই সময়ে পত্রিকার চিঠিপত্র কলামেও পাঠকের কোনো অভিযোগ বা পরামর্শ ছাপা হলেও প্রশাসনে খুব চাপ অনুভব করতো। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে ধীরে ধীরে সংবাদপত্র ও টেলিভিশন শিল্প রঙ বদলানো শুরু করলো। গণ বাদ দিয়ে হয়ে উঠলো প্রচার মাধ্যম হিসেবে। কারণ তখন সাংবাদিকরা মানুষের খবরের বদলে নিজেদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো প্রচার করা শুরু করলেন। পেতে শুরু করলেন রাজনৈতিক ক্ষমতা ও বিত্ত বৈভবের স্বাদ।
এরপর থেকে বাংলাদেশে সাংবাদিকদের মধ্যে দেখা দেয় পেশাদারিত্বের সংকট। এসব প্রচার মাধ্যম এখন হয়ে গেল পুরোদস্তর ভিউ ব্যবসায়ী। এখন কে কার আগে কন্টেন্ট বানিয়ে ফেসবুক বা ইউটিউবে আপলোড দিতে পারে। সাংবাদিকতার শর্ত বা নীতিমালা বাদ দিয়ে সবার আগে দ্রুত কন্টেন্ট আপলোড করে ভিউ বাড়াও। পাবলিগ যা বোঝে বুঝুক, না বোঝে না বুঝুক। বিয়ের দাবিতে প্রেমিকের বাড়ির সামনে কিশোরী অপেক্ষা করছে, দ্রুত তার সাক্ষাতকার নিয়ে রঙচটা কন্টেন্ট বানিয়ে মিলিয়ন মিলিয়ন ভিউ নিয়ে ডলার কামাও। এই হচ্ছে এখন মূল লক্ষ্য। টাকা পেলে মালিকও খুশি। নীতি নৈতিকতা গোল্লায় যাক। তাই সচেতন পাঠকও এখন সংবাদ মাধ্যম বিশ্বাস করে না। তারা আগে দেখে- কোন পত্রিকা বা টিভিতে খবর প্রচার হচ্ছে। সেটার মালিক কোন দলের, দর্শকরা সেই বুঝে খবর আমলে নেন।
আমি বলি- কন্টেন্ট বানানো দোষের না, এ দিয়ে টাকা কামানোও দোষের না। দোষের হচ্ছে- আমরা ভিউ ব্যবসার জন্য কন্টেন্টে দিচ্ছিটা কী ! সমাজের জন্য কোনো দায়বদ্ধতা থেকে এগুলো কী করা হচ্ছে? এর সরকারি কোনো নীতিমালা আছে? কোন খবর প্রচারে মানুষের মনে কী প্রভাব পড়ে, সেগুলোর কোনো বাছ বিচার আছে কোথাও? জানামতে নেই। এখন এ বিষয়ে ভাবা দরকার। জরিপ করা দরকার- এই ভিউ ব্যবসায় সমাজে ইতিবাচক না নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে, এটা বোঝা দরকার। সিগারেটের মতো এভাবে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে এক সময় নিজে তো ক্যানসারে মরতেই হবে, মরতে হচ্ছে সাধারণ মানুষগুলোকেও।
এ দেশের গণমাধ্যম ধ্বংসের পেছনে দায় শুধু সরকারেরই নয়। এ পেশায় যারা উচ্চশিরে বসে শুনামের সঙ্গে বহু পয়সা ও সুযোগ সুবিধা কামিয়েছেন, তারাও। তাদের অনৈতিক চিন্তা ও দলদাসত্বের কারণে এমনটা হয়েছে। আর এই সুযোগে সাংবাদিকতা এখন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করছে কথিত করপোরেট সিস্টেম। সাংবাদিক নিয়োগ হবে? এইচআরের মতামত লাগবে। সাংবাদিকের পদোন্নতি লাগবে? এইচআর সিদ্ধান্ত দিবে। কোন নিউজ প্রচার হবে কিংবা কোন ভাবে ট্রিটমেন্ট দিতে হবে, তাও মালিক পক্ষের ওহি জারি থাকে। সেখানে চাকরির তাগিদে পেশাগত সাংবাদিকদেরও কিছু করার থাকে না। কারণ মালিকের কথা না শুনে সাংবাদিকতা করলে তো চাকরি থাকবে না। আহারে! সাংবাদিকতা!
এইচআর এখন সাংবাদিকদের নিয়ন্ত্রণ করে। তারা বলে দেয়- এটা করতে পারবা, এটা পারবা না। তাদের নির্দেশিত নিয়মে কড়া আট ঘণ্টা অফিসে ডিউটি করতে হবে। এক মিনিট এদিক-ওদিক হলে বেতন টাকা। অথচ-বড় অনেক টিভি চ্যানেলে বছরের পর বছর দুই থেকে তিনমাসের বেতন বাকি। বেতন-ভাতা ঠিকমতো দিতে পারে না। তবুও হিসাবের খাতা থেকে তার বেতন কাটা।
এখানে মেধা খাটিয়ে কিছু ভাবনার সুযোগ নেই। কর্মীদের মেধা খাটানোর সময় হয় না। অথচ যেকোন দুর্যোগ বা দুরাবস্থায় একজন সাংবাদিকের নাওয়া-খাওয়া ঘুম থাকে না। তখন এই এইচআর ম্যানেজাররা বাসায় বসে টিভিতে সব মনিটরিং করেন। সরকারি সব ছুটিতে তাদের উপস্থিতি শূন্য। কিন্তু সাংবাদিকদের ছুটি নেই। জীবন বাজি রাখতে হয় প্রতিনিয়তই। ঝড়-ঝঞ্ঝার মধ্যে যেতে হয়, গুলি ও মাইরের সামনে পড়তে হয় । কখনো কখনো জীবন হারাতে হয়। অথচ তাদের ওপর খরগ চালায় কথিত এইচআর। এ যেন মুক্ত পেশার নামে শেকল বাঁধা জীবন!
সাংবাদিকতা পেশায় আগে শিক্ষিত ও স্বাধীনচেতা মানুষরাই আসতেন। মন খুলে লিখতেন। তারা কর্মক্ষেত্রে জুনিয়রদের যেমন শাসন করতেন, তেমনি স্নেহও করতেন অন্তর দিয়ে। আর এখন সবকিছু নিরূপণ হয় ব্যক্তিস্বার্থ দিয়ে। তেলবাজি কিংবা রাজনীতির শক্তি দিয়ে।
এসব নানা কারণেই এই পেশার ভবিষ্যত অন্ধকার। কারণ মেধাবী বা নতুন প্রজন্মের বুদ্ধিমানদের কেউ এখন এ পেশায় আসতে চায় না। সাংবাদিকদের ছেলে-মেয়েরা তো নয়ই। অথচ সাংবাদিকতা পেশা একসময় ছোটবেলায় বহু মানুষের স্বপ্ন ছিল।
স্বপ্ন থাকবে কী করে? নাম করা বড় বড় টিভি চ্যানেলে যুগ্ম বার্তা সম্পাদক পদের জন্যই অফার করে ৩০ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ৩৫ হাজার টাকা বেতন। এর বেশি হলেই বলে বাজেট নাই। বার্তা সম্পাদকদের বেতনও ৩৫-৪০ এর মধ্যে। অভিজ্ঞতা, পদ ও বাজার মূল্যের সঙ্গে বেতনের কোনো সামঞ্জস্যতা নেই। তাহলে একজন নবাগত সাংবাদিকের বেতন কত হতে পারে, তা সহজেই অনুমান করা যায়। এভাবেই বাংলাদেশে সাংবাদিকতা পেশার সংকট ক্রমেই বাড়ছে।
আগে দেখতাম সরকার পরিবর্তন বা পতনের পর বাসকাউন্টারগুলো রাতারাতি দখল হয়ে যেত। কিন্তু গত ৫ আগস্টের পর দেখা গেল অনেক টেলিভিশন ও পত্রিকা অফিসে মব বাজি করে পুড়িয়ে দেওয়া হলো। কোনো বিচার হলো না। এরপর ধীরে ধীরে বেশকিছু টিভি-পত্রিকার নিয়ন্ত্রণও নিয়ে নেয় ক্ষমতাসীন সমর্থক সাংবাদিকরা। ভবিষ্যতে এই পেশার কী হবে, তা অজানা। তবে ধারণা করা যায়। দেশের স্বার্থ তাদের কাছে মুখ্য নয়। তাদের চাই কাঁড়ি কাড়ি টাকা-ক্ষমতার স্বাদ। এ থেকে মুক্তি মিলবে কীভাবে?
অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর গণমাধ্যম কমিশন গঠন করে নানান আওয়াজ দেওয়া হচ্ছে। জেলায় জেলায় গিয়ে কমিশন চেয়ারম্যান সাংবাদিকদের মতামত শুনছেন সরকারি পয়সায়। কিন্তু এখন পর্যন্ত সবই অন্ত:সার শূন্য। এসব কমিশন-শুনানি ও সুপারিশ দিয়ে সাংবাদিকতার জীবনে কি আদৌ মুক্তির স্বাদ মিলবে?
লেখক: সাংবাদিক ও বাণীবিতান ডটকমের সম্পাদক। ইমেইল: biplobgenis@gmail.com