শিশুর জন্য সংগীত কেন জরুরি!

শিশুদের সংগীত শিক্ষা
সঙ্গীত শিক্ষা ছোটবেলা থেকেই জীবনে শান্তি ও শৃঙ্খলা আনে।

বিপ্লব রায়।।

সংগীত এমন এক মাধ্যম, যা শুধু মানুষ নয় প্রকৃতির অন্য প্রাণীদেরও আকর্ষণ করে। গাছপালাও সংগীতের ভাষা বোঝে। কথায় আছে- সঠিক ও সুন্দর ভাবে কন্ঠে সুর তুলতে পারলে ভূতও চুপ হয়ে যায়। তাই শৈশব থেকেই সংগীত যে প্রতিটি জীবনে কতটা অপরিহার্য, তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। কারণ শৈশব থেকে সুরকে হৃদয়ে ধারণ করতে পারলে জীবনটা সত্যি সুন্দর হয়ে ওঠে।

আর এজন্যই উপমহাদেশের বিখ্যাত সানাই বাদক উস্তাদ মিসমিল্লাহ খান বলেছিলেন, ‘দুনিয়ার সব নেতাদের সঙ্গীত শিখিয়ে দাও,
কেননা গানওয়ালারা কোন দিন যুদ্ধ লাগায় না’। এই কথা শুধু রসিকতা নয়, গভীর সত্য।

সংগীত শুধু মানুষকে সুরই শেখায় না। শেখায় ঈশ্বরের প্রতি গভীর অনুভব, শিষ্টতা, ভদ্রতা, নমনীতা ও উদারতা। কেউ যখন হৃদয় দিয়ে সুরের সাধনা করেন, তখন তাঁর শরীরের মধ্যে নতুন নিউরণন ও অনুরণন সৃষ্টি হয়। এজন্যই ছোটবেলা থেকেই শুদ্ধ শিক্ষকের কাছে সংগীত জীবনের পথচলা শুরু করতে হয়। তবেই পাওয়া যায় জীবনের আসল দর্শণ। আর এজন্য প্রয়োজন পারিবারিক শিক্ষা। পরিবারকে এজন্য অগ্রণী ভূমিকা রাখতে হয়।

সাধারণ দৃষ্টিতে সংগীত বলতে আমরা গানকেই বুঝি। উচ্চাঙ্গ সংগীত শুনলে সেখান থেকে দূরে সরে যাই। কিন্তু যারা দূরে চলে যাই, তাদের কেউ কখনো এই সংগীত সমুদ্রের কিনারেও হাঁটেননি। বুঝতেও চেষ্টা করেননি কখনো। এর মধ্যে রয়েছে- সুর, তাল, লয় ও ছন্দ। যা রপ্ত করতে হলে সাধনার প্রয়োজন। তাই সংগীতকে বলা হয় গুরুমুখী বিদ্যা। যা অভিজ্ঞ গুরু ছাড়া কখনো সঠিক ভাবে রপ্ত করা যায় না।

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, মানব জীবনের গভীরতম অনুভূতিগুলি কখনোই শুধু শব্দ দিয়ে প্রকাশ করা যায় না। সেখানে প্রয়োজন হয় সুরের। এই কারণেই তিনি সঙ্গীতকে আত্মার সঙ্গে সম্পর্কিত বলে মনে করতেন। তাইতো তিনি লিখেছেন-
“তোমার সৃষ্টি সুখের উল্লাসে—
তোমারি সঙ্গীত বাজে, বিশ্বে বিশ্ব ‘

তাই ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতে বলা হয়— “নাদ ব্রহ্ম”। অর্থাৎ সুর নিজেই ঈশ্বরের রূপ। আর উপনিষদেও বলা আছে—“সঙ্গীত ঈশ্বরের সান্নিধ্যের পথ।

গবেষণায় জানা গেছে, ছোটবেলা থেকেই সংগীতের প্রতি যাদের অনুরাগ, তারা জীবনের সৌন্দর্য, রুচি, সংবেদনশীলতা এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের পাঠও শিখে যায়। তাদের মস্তিস্ক ভিন্ন ভাবে গড়ে ওঠে। তারা পাখির ভাষা বোঝে, প্রকৃতির ভাষা বোঝে। তাইতো অঝোর বৃষ্টিতে কারো কারো কন্ঠে অবচেতন মনে গেয়ে ওঠে- আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদর দিনে….কিংবা, আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার…পরাণ সখা বন্ধু আমার!

তিন দশক আগেও বিশেষ করে হিন্দুদের প্রায় প্রতিটি বাড়িতে সংগীতের পরিবেশ ছিল। কোন কোন বাড়িতে নিয়মিত বসতো গানের আসর। এখন আর তেমনটা নেই বললেই চলে। ঢাকা শহরে সংগীত শিক্ষা কিংবা চর্চার প্রচলন অনেক জ্ঞানী মুসলিম পরিবারের মধ্যেও রয়েছে। কিন্তু ঢাকার বাইরের শহরগুলোতে তেমনটা নেই। যা-ও আছে, তা কিছু গুণীজনের কারণে। যাঁরা সংগীতের শেকরকে সেই ছোটবেলা থেকেই হৃদয়ে গেঁথে রেখেছেন সন্তানের মতো। অথচ ইতিহাসে সংগীতের বড় বড় অনেক গুণী ওস্তাদ ছিলেন ইসলাম ধর্মের।  যাঁদের কাছে সংগীত ছিল পরম করুণাময়ের সান্নিধ্য পাওয়ার অন্যতম মাধ্যম।

তবে এটা ঠিক, সংগীত কোনো সহজ বিষয় নয়। একে রপ্ত করতে হলে নিয়মিত সাধনার প্রয়োজন। সংগীত গুরুরা বলেন- শখ করে কখনো সংগীত শিখতে আসবেন না। কারণ, সংগীত শখের বিষয় নয়। এটা সাধনার। সংগীতের মাধ্যমে ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভ করা যায়। তাই এই সাধনা প্রাণ দিয়ে নিয়মিত করতে হয়।

আজকের দিনে যেখানে হিংসা, বিদ্বেষ, বিভাজন বাড়ছে, সেখানে সংগীত হতে পারে শান্তির এক অনন্য পথ। কারণ সঙ্গীত মানুষকে একাত্ম হতে শেখায়। কারণ ভাষা ও ধর্ম ভিন্ন হতে পারে, কিন্তু সুরের ভাষা সবার এক।

বিখ্যাত ফরাসি দার্শনিক ভিক্টর হুগো বলেছিলেন—“Music expresses that which cannot be put into words and that which cannot remain silent.”। অর্থাৎ “সংগীত এমন কিছু প্রকাশ করে, যা শব্দ দিয়ে বলা যায় না; আবার চুপ থাকাও যায় না।”

বর্তমান যান্ত্রিক জীবনে বেশির ভাগ মানুষ এখন তাদের সন্তানকে কথিত উচ্চ শিক্ষার জন্য শুধু স্কুল আর বই মুখস্ত করার প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত। কিন্তু নৈতিক শিক্ষার জন্য সংগীত যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, সে সম্পর্কে ধারণা নেই আজকারের শিক্ষক কিংবা অভিভাবক কারোরই। এখন বিশেষ করে বাংলাদেশে ভিন্ন ধারার নানান চিন্তা প্রবেশ করানো হয়েছে অভিভাবক ও শিশুদের মনে। তাই সংগীত এখন বাংলাদেশে কোনো ভাবে জোড়াতালি দিয়ে টিকে আছে। কারণ এখানে সংগীতকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করার সুযোগ নেই। কেউ নিতে গেলে তাকে অর্থকষ্টে ভুগতে হয়।

তবে এটি সত্য যে, জীবনের প্রকৃত অর্থ ও সৌন্দর্য অনুধাবন করতে চাইলে, সুরের সাথে বন্ধুত্ব করতেই হবে। সংগীতকে হৃদয়ে ধারণ করলেই পাওয়া যাবে প্রকৃত জীবনদর্শন।

 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top