শাহ আব্দুল করিম: গভীর চিন্তার এক বাউল

বিপ্লব রায়।

শাহ আব্দুল করিমের  দর্শন, চিন্তা এত গভীর ছিল যে, সাধারণের পক্ষে তাঁর নাগাল পাওয়া কঠিন ছিল।  কারণ তিনি ছিলেন অসীম।  এই অসীমের সীমানা যে কেউ পেতে পারে না। তবে শাহ আবদুল করিম নিজেকে বিলিয়ে দিতেন অকাতরে।

পশ্চিমবঙ্গের প্রখ্যাত সংগীত শিল্পী (প্রয়াত) কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্য এই বাউলের পরম ভক্ত ছিলেন।  তিনি মনে প্রাণে শাহ আব্দুল করিম’কে ধারণ করতেন।  অনুধাবনের চেষ্টা করতেন এই বাউলকে।  কিন্তু সব সময় তাকে চিনতে পারতেন না।

কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্য একবার বাউল শাহ আবদুল করিমকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “মানুষ আপনার গান বিকৃত সুরে গায়। আপনার সুর ছাড়া অন্য সুরে গায়। অনেকে আপনার নামটা পর্যন্ত বলে না।  এসব দেখতে আপনার খারাপ লাগে না?”

কালিকাপ্রসাদ হয়তো ভেবেছিলেন, বাউল হয়তো ক্ষুব্ধ হবেন।  মন খারাপ করবেন।  কিন্তু না।  মরমী বাউল শাহ আবদুল করিম রাগেননি।  বরং যে উত্তর দিয়েছেন, তা শুনে চমকে গেলেন কালিকাপ্রসাদ।

প্রশ্নের জবাবে শাহ আবদুল করিম বললেন, “কথা বোঝা গেলেই হইল।  আমার আর কিচ্ছু দরকার নাই।”

কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্য আশ্চর্য হয়ে বললেন, “আপনার সৃষ্টি, আপনার গান। মানুষ আপনার সামনে বিকৃত করে গাইবে।  আপনি কিছুই মনে করবেন না। এটা কোনো কথা, এটার কোনো অর্থ আছে!”

জবাবে শাহ আবদুল করিম বললেন, “তুমি তো গান গাও, আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দাও তো।  ধরো, তোমাকে একটা অনুষ্ঠানে ডাকা হলো।  হাজার হাজার চেয়ার রাখা আছে, কিন্তু গান শুনতে কোনো মানুষ আসেনি।  শুধু সামনের সারিতে একটা মানুষ বসে আছে।  গাইতে পারবে?”

কালিকাপ্রসাদ কিছুক্ষণ ভেবে উত্তর দিলেন, “না, পারব না।” শাহ আবদুল করিম হেসে বললেন, “আমি পারব।  কারণ আমার গানটার ভেতর দিয়ে আমি একটা আদর্শকে প্রচার করতে চাই, সেটা একজন মানুষের কাছে হলেও।  সুর না থাকুক, নাম না থাকুক, সেই আদর্শটা থাকলেই হলো। আর কিছু দরকার নাই৷ সেজন্যই বললাম শুধু গানের কথা বোঝা গেলেই আমি খুশি।”

কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্য জানতে চাইলেন, “সেই আদর্শটা কী?”

শাহ আবদুল করিম আবার হেসে বললেন, “একদিন এই পৃথিবীটা বাউলের পৃথিবী হবে।”

বৃহত্তর সিলেটের সুনামগঞ্জের হাওর বেষ্টিত একটি এলাকা দিরাইয়ের উজানধল গ্রাম।  আজ থেকে শতাধিক বর্ষ আগে ১৯১৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ওই গ্রামের হতদরিদ্র একটি পরিবারে আলোকবর্তিকা হয়ে জন্মেছিলেন শাহ আবদুল করিম।  তাই ক্ষুধা আর দারিদ্রের সঙ্গেই দিন কেটেছে ছোটবেলা থেকে।

তাই প্রথাগত স্কুল-কলেজে পড়াশোনা আর হয়নি তাঁর।  বয়স বেড়ে একটু বোঝার পর থেকে  পরিবারের হাল ধরতে রাখাল বালকের চাকরি নেন।  কিন্তু তার ছিলো গানের প্রতি, সুরের প্রতি প্রচণ্ড ঝোঁক।

সময় পেলেই তাই চলে যেতেন কালনী নদীর ঘাটে।  সেখানে নিরালায় বসে একসময় একা একা গান লিখে সুরে সুরে গাইতে শুরু করেন।  এভাবে গাইতে গাইতেই হয়ে ওঠেন ভাটি-বাংলার অন্যতম বাউল ও গণমানুষের কণ্ঠস্বর।

মাত্র আট দিন ব্রিটিশদের পরিচালিত নৈশ বিদ্যালয়ে পড়েছিলেন তিনি। এরপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে গুজব রটানো হলো বিদ্যালয়ের ছাত্রদের ব্রিটিশ বাহিনীতে যোগ দিয়ে যুদ্ধ করতে হবে।  সেই আশঙ্কায় সকল ছাত্রের সাথে সাথে তিনিও ছাড়লেন বিদ্যালয়। কিন্তু নিজের চেষ্টা আর সাধনায় কাজ চালানোর মতো পড়াশোনা ঠিকই শিখেছিলেন তিনি। সেই পড়াশোনা আর জীবনের বাস্তবতাকে কাজে লাগিয়ে রচনা করে ফেলেন প্রায় দেড় হাজার গান।  যার অনেকগুলোই এখন মানুষের মুখে মুখে ফেরে।

গোটা সমাজ ব্যবস্থা যখন সাম্প্রদায়িকতার দিকে ধাবিত হয়ে অন্ধকার করে দিয়েছে চারপাশ।  তখনও আপদমস্তক তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক।  চর্চা করতেন সাম্যবাদের।  মানুষের অধিকারের।

তিনি নিজের চোখেই দেখতে পাচ্ছিলেন, এই সমাজটা সাম্প্রদায়িকতার রসাতলে যাচ্ছে।  তাইতো গান বেঁধেছিলেন-

গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু মুসলমান
মিলিয়া বাউলা গান আর মুর্শিদি গাইতাম

হিন্দু বাড়িতে যাত্রা গান হইত
নিমন্ত্রণ দিত আমরা যাইতাম
জারি গান, বাউল গান
আনন্দের তুফান
গাইয়া সারি গান নৌকা দৌড়াইতাম

সমাজে আলো জ্বালতে গিয়ে অন্ধকার সমাজের লোকদের নানা প্রতিরোধে পড়তে হয়েছে শাহ আব্দুল করিম’কে।  অনেক অপবাদ, কটুকথা প্রতিনিয়ত শুনতে হতো।  সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর দলে যোগ না দেওয়ায় তাকে উপাধি দেওয়া হয়েছিল কাফের হিসেবে।  তবুও থেমে যাননি এই মানুষটি।  তিনি জানতেন, এই আলো জ্বালবার পথটি সহজ নয়।

নির্লোভ এই বাউলের কখনো অর্থ-প্রতিপত্তির প্রতি ঝোঁক ছিল না। উজান ধল গ্রামটিই ছিল তাঁর সবচেয়ে বড় সম্পদ।  সেখানের সরল মানুষগুলোর হৃদয় তার কাছে ছিল মহামূল্যবান।  সারাজীবন অভাব-অনটন ও কষ্টে-সৃষ্টে কাটালেও নির্লোভ ছিলেন জীবনের শেষদিন পর্যন্ত।

তার গান গেয়ে কতজন কতভাবে টাকা কামিয়েছে, কতজন তাকে কেন্দ্র করে কত ধরনের ব্যবসা করেছে, কিন্তু তিনি এসব জেনেও ছিলেন নির্বিকার। তাকে তার গানের অ্যালবাম থেকে প্রাপ্ত সোয়া তিন লাখ টাকা দেয়া হলে তিনি নিতে চাননি।  বলেছিলেন, এত টাকা তার দরকার নেই, তাকে যে সম্মান দেওয়া হচ্ছে এটাই যথেষ্ট নয় কী!

২০০১ সালে একুশে পদকে ভূষিত করা হয় এই মহান গুণীকে।

 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top