যেভাবে প্রচলন হলো বাঙালির হালখাতা

হালখাতা
বাঙালির ঐতিহ্য হালখাতা

বিপ্লব রায়।।

দরজায় কড়া নাড়ছে বাঙালির প্রাণের উৎসব-পহেলা বৈশাখ। তাই সংস্কৃতিসেবী কিংবা মুক্তচিন্তার মানুষগুলোর মধ্যে যেন প্রাণে খুশির জোয়ার এসেছে। কন্ঠেও ভাসছে অমৃত সেই সুর- এসো হে বৈশাখ, এসো এসো…। কিংবা ঘুচে যাক গ্লানি, মূছে যাক জরা। যদিও রাজনীতির মারপ্যাচ ও বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলে অনেকেই নববর্ষ উদযাপন নিয়ে ইচ্ছেমতো মত দিয়ে সুন্দরের গায়ে অন্য পোশাক জড়িয়ে দিতে চাইছেন, কিন্তু সত্যের শেকড় তো তুলে ফেলা সম্ভব নয়। তার ধারাবাহিকতায়ই তো যুগ যুগ ধরে চলে আসছে বাঙালি সংস্কৃতির প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখ বা বাংলা নববর্ষ উদযাপন। আর এই উৎসবের এক অন্যতম অনুসঙ্গ হলো হালখাতা’। বাংলা প্রতি বছর শেষ চৈত্র থেকে শুরু হয় এই খাতার ব্যবহার।

আগে চৈত্র মাসের শেষ দিন চৈত্রসংক্রান্তিতে জমিদারকে খাজনা পরিশোধ করতেন প্রজারা। আর এই টাকা আদায়ের সময়ে জমিদারের কর্মচারিরা বছরের প্রথম দিন পয়লা বৈশাখে প্রজাদেরকে জমিদাররা বাহারি মিষ্টি, পান-সুপারি দিয়ে আপ্যায়ন করতেন। নববর্ষের হালখাতায় পুরনো বছরের খাজনা আদায়ের হিসাব-নিকাশ সম্পন্ন করে খুলতেন। হিসেবের নতুন খাতা। এ প্রথার মাধ্যমে দেনাদার ও পাওনাদারের মধ্যে বিশ্বাস, আস্থা ও গভীর সম্পর্কের প্রকাশ ঘটত। এটা ছিল সৌজন্য প্রকাশের এক অন্যরকম ঐতিহ্য।

যদিও সাম্প্রতিককালে প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও বাংলাদেশে নানা বাস্তবতায় অনেকে এসব সংস্কৃতি এড়িয়ে । তবে হিন্দু অনেক ব্যবসায়ী বিশেষ করে স্বর্ণকার, সাহা ও বণিকসহ অনেকে এখনো এই প্রথা ধরে রেখেছেন। চৈত্র সংক্রান্তির আগেই তাদের দোকান ধুয়ে-মূছে রাখেন। এরপর পাওনাদারদের কাছ থেকে বকেয়া টাকা আদায় করে তাদেরকে মিষ্টিমুখ করান। ক্রেতারা বকেয়া টাকা আদায়ের পর খাতা থেকে তাদের নাম কেটে লিখে দিতেন ‘পরিশোধ’। এরপর ব্যবসায়ীরা খোলেন লাল কাপড়ে বাঁধাই করা নতুন হিসাবের হালখাতা। এর আগে বকেয়া টাকা পরিশোধ করার জন্য শুভ হালখাতা- লিখে কার্ড ও পাওনা টাকার হিসেব লিখে ক্রেতাদের কাছে পাঠান ব্যবসায়ীরা। এরপর হালখাতার নির্দিষ্ট দিনে ক্রেতারা গিয়ে দোকানের বকেয়া পাওনা পরিশোধ করেন তারা। এসময় তাদেরকে মিষ্টিমুখ করানো হয়।

পয়লা বৈশাখে পুরনো খাতা বাদ দিয়ে হালখাতা শুরুর আগে নতুন খাতা নিয়ে মন্দিরে গিয়ে পূজো দেন অনেকে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে এ অনুষ্ঠানটি এখনও বেশ ঘটা করে উদযাপিত হয়। তারা গণেশ এবং লক্ষ্মী দেবীর পূজো করে ‘হালখাতা’ নতুন বছরের হিসেব-নিকেশ শুরু করেন।

জানা যায়, একসময় বাংলার নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ একটি রীতি প্রচলন করেছিলেন, তখনকার সময়ে যা একসময় ‘পুণ্যাহ‍‍’ হিসেবে পরিচিত ছিল। কালের পরিক্রমায় ‘পুণ্যাহ‍‍’ উৎসব হারিয়ে গেলেও হালখাতা এখনও টিকে রয়েছে।

তবে নবাবদের খাজনা পরিশোধের পর নতুন হিসেবের সূচনার পাশাপাশি হালখাতার আলাদা একটি ইতিহাস রয়েছে। ‘হাল’ শব্দটি সংস্কৃত এবং ফারসি– উভয় ভাষা থেকে আসলেও অর্থগত দিক থেকে এর ভিন্নতা রয়েছে। সংস্কৃত ‍‍‘হাল‍‍’ শব্দের অর্থ ‘লাঙল‍‍’। যে কারণে আমরা বলি হালচাষ। অন্যদিকে ফারসি ভাষায় ‍‍‘হাল‍‍’ এর অর্থ হচ্ছে ‍‍‘নতুন‍‍’। বাঙালি সমাজে ‘হালখাতা‍‍’র ক্ষেত্রে এই দুটো অর্থই প্রসঙ্গিক। কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে, হালখাতার ইতিহাস কৃষিপ্রথার সাথে সম্পর্কিত। কারণ, কৃষিপ্রথার সূচনার পর হাল বা লাঙল দিয়ে বিভিন্ন কৃষিজাত পণ্য উৎপাদনের পর সেই পণ্য বিনিময়ের হিসেব একটি বিশেষ খাতায় লিখে রাখা হতো, যেটি ‍‍‘হালখাতা‍’ হিসেবে পরিচিত ছিল।

(প্রিয় পাঠক, বাঙালির ঐতিহ্য ও হালখাতা সম্পর্কে জানতে এই লিংকে প্রবেশ করে কমদামে ‘বাঙালির হালখাতা’ বইটি সংগ্রহ করতে পারেন)

পহেলা বৈশাখের আয়োজন:
বঙ্গাব্দের প্রথম দিন বা বাংলা নববর্ষ। দিনটি যুগ যুগ ধরে বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গে নববর্ষ হিসেবে ব্যাপক আয়োজন করা হয়। এ দিনে চারদিকে ধ্বনিত হয় বাঙালির প্রাণছোঁয়া নানা গান। কেউ আবৃত্তি করে কবি গুরুর শতবর্ষ কবিতাখানি। নর-নারী সবাই পরেন নতুন কাপড়। ছেলেরা পাঞ্জাবি আর মেয়েরা পরেন হলুদ কিংবা সাদা ও লাল পাড়ের শাড়ি। খোঁপায় ফুলের গুচ্ছ। নববর্ষের সময় বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ সব শহর-বন্দরে আয়োজন করা হয় বর্ণাঢ্য মঙ্গল শোভাযাত্রা। এসময় একে অন্যের সঙ্গে দেখা বা কথা হলেই শুভ নববর্ষ বলে সম্ভাষণ জানান। সবার প্রাণে নতুন প্রেমের আবাহনে বাংলা নববর্ষের এই দিনটি বাঙালির একটি সর্বজনীন লোকজ উৎসব হিসাবে বিবেচিত।

গ্রেগরী বর্ষপঞ্জি অনুসারে বাংলাদেশের প্রতি বছর ১৪ এপ্রিল এই উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। বাংলা একাডেমি নির্ধারিত আধুনিক বাংলা পঞ্জিকা অনুসারে এই দিন নির্দিষ্ট করা হয়েছে। শোভাযাত্রা, মেলা, পান্তা খাওয়া, হালখাতা খোলা এরকম বিভিন্ন আয়োজনে উদ্‌যাপন করা হয় এই দিন।
অন্যদিকে চান্দ্রসৌর বাংলা পঞ্জিকা অনুসারে পশ্চিমবঙ্গে বাংলা নববর্ষ উদযাপিত হয় ১৫ এপ্রিল। ব্যবসায়ীরা নতুনভাবে ব্যবসা শুরু করার উপলক্ষ হিসেবে বরণ করে নেন এই দিনটিকে।

তথ্যসূত্র: রোর মিডিয়া,
প্রথম আলো অনলাইন,১৩ এপ্রিল ২০১৮

 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top