বিপ্লব রায়।।
সক্রেটিস। যে মহামানবের নাম মনে এলেই তাঁর প্রতি শ্রদ্ধায় বুক ভরে ওঠে। অতি সহজ-সরল জীবন যাপন করেও বিশ্বের সব জ্ঞানীর কাছে যাঁর আকাশ ভরা সম্মান। যিনি তাঁর কর্ম ও বাণী দিয়ে আজো সারা বিশ্বের কাছে অমর।
সক্রেটিস একজন বিশ্ববিখ্যাত দার্শনিক। তাঁর আসল নাম সক্রাত্যাস্। বিশ্বে যত বড় বড় দার্শনিকের জন্ম হয়েছে তাদের মধ্যে সবচেয়ে অন্যতম তিনি। সক্রেটিসের নাম শোনেননি, এমন মানুষ পাওয়া সত্যিই কঠিন।
সক্রেটিসের জন্ম ইউরোপের দেশ গ্রিসে। ৪৭০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। তাই এথেন্সকে বলা হয় ‘সভ্যতার আঁতুরঘর’। কারণ ওই এথেন্স শহরের প্রতিটি পদে পদে কয়েক হাজার বছরের ইতিহাসের ছাপ রয়েছে। এথেন্স শহরের সবচেয়ে বিখ্যাত দর্শনীয় স্থান অ্যাক্রোপোলিস। তার স্ত্রীর নাম জানথিপির বয়স ছিল সক্রেটিসের থেকে অনেক কম। সংসার জীবনে তাঁদের তিন পুত্রসন্তানের জন্ম হয়। যাঁদের নাম ছিল লামপ্রোক্লিস, সফ্রোনিস্কাস এবং মেনেজেনাস। সক্রেটিস তাঁর শাস্তি কার্যকর হওয়ার পূর্বে পালিয়ে যাওয়ার অনুরোধ ফিরিয়ে দেন। এর পর নিজ পুত্রদের ত্যাগ করার জন্য সক্রেটিসের বন্ধু ক্রিটো তার সমালোচনা করেছিলেন।
এবার বলছি সক্রেটিসের জীবনের উল্লেখযোগ্য কিছু কথা।
তৎকালীন শোষকদের বিপক্ষে ছিলেন মহান এই দার্শনিক। তাই শোষকরা তাকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেয়। এ নিয়ে মোটেও দুশ্চিন্তার ছাপ নেই সক্রেটিসের মনে। ছিলেন সদা হাস্যজ্জ্বল। সাহসী। কারণ তিনি জানতেন, মৃত্যুর স্বাদ তো সবাইকেই একদিন গ্রহণ করতে হবে। তাহলে অমানুষের কাছে মানুষ কেন মাথা নত করবে?
সক্রেটিস সর্বদা বিশ্বাস করতেন- সমস্ত গুণাবলী জ্ঞানের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। তিনি আরও বিশ্বাস করতেন যে মানুষ যা ইচ্ছা করে তা বোঝার জন্য জ্ঞানীয় শক্তি দ্বারা পরিচালিত হয়, যখন আবেগের ভূমিকা হ্রাস করে।
সক্রেটিস জ্ঞান প্রত্যাখ্যান করার জন্য পরিচিত, “আমি জানি যে আমি কিছুই জানি না”। এই কথার মধ্যে একটি দাবি অন্তর্ভুক্ত। প্লেটোর ক্ষমার একটি বিবৃতির ভিত্তিতে এটি প্রায়ই সক্রেটিসকে দায়ী করা হয়। যদিও একই দৃষ্টিভঙ্গি বারবার প্লেটোর সক্রেটিসের প্রথম দিকের লেখার অন্য কোথাও পাওয়া যায়।
তাঁর মৃত্যুর আগের একটি গল্প বলি-
মহাজ্ঞানী সক্রেটিসের মৃত্যুদন্ড কার্যকর হবে সন্ধ্যায়। তখনকার নিয়ম অনুযায়ী পরিবারের সব সদস্য আর একান্ত শিষ্যরা তার চারপাশ ঘিরে আছেন, কারাগারের অন্ধকার ঘরে ! প্রধান কারারক্ষী এসে শেষ বিদায় নিয়ে গেলেন। কিন্তু কী অদ্ভূত! প্রধান কারারক্ষীর চোখ থেকেও যেন জল গড়িয়ে পড়ছে অনবরত। অথচ যাঁকে প্রাণত্যাগ করতে হবে একটু পর, তিনি ধীরস্থির ও শান্ত। আর যার হাতে সক্রেটিসের মৃত্যু হবে তার চোখে জল।
প্রধান কারারক্ষী এসময় বলতে থাকেন- এথেন্সের হে মহান সন্তান- আপনি আমায় অভিশাপ দিবেন না, আমি এই আদালতের দায়িত্ব পালন করছি মাত্র।. এতবছর কারাগারে কাজ করতে গিয়ে আপনার মতো সাহসী, সৎ ও মহাজ্ঞানী কাউকে কখনো দেখিনি।
৩৯৯ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে মৃত্যুর ঠিক আগে পরিবারের নারী ও শিশুদের কারাগার থেকে চলে যেতে বললেন সক্রেটিস। এরপর কারাগারের পোশাক পরলেন তিনি। এসব দৃশ্য দেখে শিষ্যরা কাঁদছেন অঝোরে। কিন্তু সক্রেটিস যেন বেপরোয়া। মৃত্যুতে কি কিছুই যায় আসে না তার। যেন মৃত্যুদণ্ডটা কার্যকর হলেই তিনি এড়িয়ে যেতে পারতেন !
সক্রেটিসের বিরুদ্ধে কী অভিযোগ জানেন তো? তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিলো:- দেবতাদের প্রতি ভিন্নমত প্রকাশ। রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্র ও তরুণদের বিপথগামী হতে উৎসাহ দেওয়া।
এথেন্সের নিয়ম অনুযায়ী খোলা মাঠে তার বিচার বসেছিলো। বিচারক ছিলেন তৎকালীন সমাজের ৫০০ জন জ্ঞানী মানুষ। এদের অনেকেই ছিলেন গ্রীসের রাজার একান্ত অনুগত। সক্রেটিসের মেধা ও বিশেষত তরুণদের কাছে তার জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হয়েই তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার মতো অমানবিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিল শাসকরা।
সক্রেটিস ইচ্ছে করলে প্রাণে বাঁচতে পারতেন। শুধু কথিত বিচারক ও শাসকদের একটু তোষন করলেই হতো। কিন্তু হায় কাঠ গড়ায় দাঁড়িয়েও বিচারকদের নিয়ে উপহাস করতে ভুললেন না সক্রেটিস। তাঁকে পান করানো হলো হেমলক বিষ। বিষ পানের কিছুক্ষণের মধ্যেই মহা অমৃতের পথে পা বাড়ালেন এই দার্শনিক।
মৃত্যুর আগে সক্রেটিস নিজেই তার আত্মপক্ষ সমর্থন করেছিলেন। কঠোর যুক্তি দিয়ে বিচারকদের প্রশ্নবাণে জর্জারিত করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, আমাকে অভিযুক্ত করা হয়েছে আমি ধর্ম মানি না। নিজের ধর্ম প্রচার করি। কিন্তু আমি তো ধর্ম একটা মানি। তাহলে আমি ধর্ম
মানি না, এ কথা তো সত্যি নয়। বিচারকেরা তার এ ধরনের একটি প্রশ্নেরও কোন উত্তর দিতে পারেনি। তবুও তারা তাকে মৃত্যুদণ্ডের সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন।
নিয়ম অনুসারে মৃত্যুর আগে একমাস কারাগারে বন্দী ছিলেন তিনি। এই একমাসে কারারক্ষীরাও তার জ্ঞানে মুগ্ধ হলেন। তারা তাকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করতে চাইলেন। অথচ তাদের এ অনুরোধ বিনয়ের সাথে না করে দিলেন সক্রেটিস। বললেন আজ পালিয়ে গেলে ইতিহাস আমায় কাপুরুষ ভাববে। তিনি মনে করতেন বীর কখনো পালিয়ে যায় না! বীরের মৃত্যু মানুষকে অমর করে।
ঐদিন সন্ধ্যায় প্রধান কারারক্ষী চলে যাওয়ার পরে জল্লাদ এলেন বিষের পেয়ালা হাতে। হেমলকের বিষ নিয়ে। সক্রেটিস জল্লাদকে বললেন কি করতে হবে আমায় বলে দাও ! জল্লাদ বললো পেয়ালার পুরোটা বিষ পান করতে হবে। একফোঁটাও নষ্ট করা যাবেনা। সক্রেটিস বললেন তবে তাই হোক। তিক্ত বিষের পুরো পেয়ালা তিনি জলের মতো করে পান করে ফেললেন। চারপাশে বসে থাকা শিষ্যরা চিৎকার করে কাঁদছেন, এমন মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না কেউ ! তখন জল্লাদ আরও কঠোর নির্দেশটি দিলো। বললো নিয়ম অনুযায়ী আপনাকে এখন কিছুক্ষণ পায়চারী করতে হবে। যাতে বিষের প্রভাব পুরোটা শরীরে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। হায় হায় করে উঠলেন সবাই।
শুধু ম্লান হাসলেন সক্রেটিস। বললেন আজীবন আইন মেনেছি। মৃত্যুতে আইন ভাঙবো কেন ? দুর্বল পায়ে উঠে দাঁড়িয়ে হাঁটলেন কিছুক্ষণ। যতক্ষণ তার শক্তিতে কুলোয়। এরপর বিছানায় এলিয়ে পড়লেন। *শিষ্যদের বললেন তোমরা উচ্চস্বরে কেঁদোনা। আমায় শান্তিতে মরতে দাও।
জল্লাদের পাষাণ মনেও তখন শ্রদ্ধার ভাব বিনয়ে আর লজ্জায় মাথা নামিয়ে নিলো সে। চাদর দিয়ে নিজের মুখ ঢেকে নিলেন সক্রেটিস। একবার চাদরটা সরালেন। একজন শিষ্যকে ডেকে বললেন প্রতিবেশীর কাছ থেকে একটা মুরগী ধার করেছিলাম আমি। ওটা ফেরত দিয়ে দিও।
সক্রেটিসের মৃত্যুর খবর এথেন্সে ছড়িয়ে পড়লে গোটা এথেন্স জুড়ে বিক্ষোভ শুরু হয়। মিছিল সহকারে এথেন্সের রাস্তায় নেমে আসে ও সক্রেটিসের বিরুদ্ধে মিথ্যা রায় দেওয়া বিচারকদের পিটিয়ে হত্যা করে। কিছু বিচারক ও জল্লাদ অনুশোচনায় আত্মহত্যা করেছিল।
এই ছিলো তার শেষ কথা। খানিক পরেই অনিশ্চিত যাত্রায় চলে গেলেন মহাজ্ঞানী সক্রেটিস। তার শিষ্যদের মাঝে সেরা ছিলেন প্লেটো। প্রায় আড়াই হাজার বছর আগের এই ঘটনাগুলো প্লেটো তার রচিত বিখ্যাত রিপাবলিক গ্রন্থে লিখে গুরুকে অমর করে গেছেন।
প্লেটোর শিষ্য ছিলেন মহাজ্ঞানী এ্যারিষ্টটল। তার রচিত বিখ্যাত গ্রন্থ দ্যা পলিটিক্স। এ্যারিষ্টটল ছিলেন সর্বকালের জ্ঞানী মানুষদের সামনের সারির একজন। আর মহাবীর আলেকজ্যান্ডার দ্যা গ্রেটের নাম আমরা সবাই জানি, এই বিশ্বজয়ী আলেকজ্যান্ডারের শিক্ষক ছিলেন এ্যারিষ্টটল।
প্রহসনের বিচারে সক্রেটিসের মৃত্যু হয়েছে ঠিকই। কিন্তু মৃত্যু তাকে মারতে পারেনি। শিষ্যদের মাঝে জ্ঞানের আলো দিয়ে বেঁচে রইবেন তিনি অনন্তকাল।
জ্ঞানবিতরনী লেখা। ভাল লাগল।
অনেক ধন্যবাদ। আপনাদের মতামত ও পরামর্শ আমাদের পাথেয়।