
বাণীবিতান ডেস্ক।।
বাউল সাধক দুর্বিন শাহ। যিনি নিজের নামে সবার কাছে খুব পরিচিতি না পেলেও তাঁর সৃষ্টি করা গান ঠিকই শ্রোতাদের হৃদয় ছুঁয়েছে।
নমাজ আমার হইল না আদায়, বেলা গেল সন্ধ্যা হল আর কি বাকি আছে বল কিংবা নির্জন যমুনার কূলে বসিয়া কদম্বতল’ এই গানগুলো শোনেননি, এমন মানুষ খুব বেশি হয়তো পাওয়া যাবে না। আর এসব গানেরই স্রষ্টা বাউলসাধক দুর্বিন শাহ।
বিখ্যাত ব্যান্ডশিল্পী আনুশেহ আনাদিলের কন্ঠে নমাজ আমার হইল না আদায়- এ গানটি একসময় শহর থেকে গ্রামের অলিগলিতেও সাউন্ডবক্সে কিংবা রেডিওতে বেশ শোনা যেত। পাড়া মহল্লায় আয়োজিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে এই গান গেয়ে মঞ্চ মাতিয়ে দিতেন তরুণ শিল্পীরা। এমন অসংখ্য গান রচনা করেছেন বাউলসাধক দুর্বিন শাহ। তাঁর প্রতিটি গানের মধ্যেই রয়েছে আত্মদর্শন ও আধ্যাত্মবাদের কথা। যা অনেকে বুঝতেন আবার অনেকে বুঝতেন না।
দুর্বিণ শাহের লেখা ‘নমাজ আমার হইল না আদায়’ গানটি ১৯৭৪ সালে কলকাতার প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক ঘটক তার ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’ চলচ্চিত্রে ব্যবহার করেছিলেন। ঢাকার উৎস প্রকাশন থেকে লোকসাহিত্যের গবেষক সুমন কুমার দাশ সম্পাদিত ‘দুর্বিন শাহ সমগ্র’ বইয়ে দুর্বিনের সমস্ত রচনাসম্ভার স্থান পেয়েছে।
বাউলসাধক দুর্বিন শাহ ছিলেন একজন মরমী গীতিকবি, বাংলা লোক সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষ্যকার। সুফি ও মরমিবাদের গানের পাশাপাশি তিনি লিখেছেন বিচ্ছেদ, আঞ্চলিক, গণসংগীত, মালজোড়া, জারিসারি, ভাটিয়ালি, গোষ্ঠ, মিলন, রাধা-কৃষ্ণ বিষয়ক পদাবলী, হামদ-নাত, মারফতি, পির-মুর্শিদ স্মরণ আলা স্মরণ, নবী স্মরণ, অলি স্মরণ, ভক্তিগীতি, মনঃশিক্ষা, সুফিতত্ত্ব, দেহতত্ত্ব, কামতত্ত্ব, নিগূঢ়তত্ত্ব, পারঘাটাতত্ত্ব ও দেশের গান। তাই সঙ্গীত প্রেমীরা তাকে ‘জ্ঞানের সাগর’ উপাধিতে ভূষিত করেন।
দুর্বিণ শাহের সঙ্গে বেশ ঘনিষ্ঠতা ছিল আরেক মরমী কবি বাউল শাহ আবদুল করিমের। এই দুজন ছিলেন হরিহর আত্মা। এজন্যই ১৯৬৭ সালে প্রবাসী বাঙালিদের আমন্ত্রণে ইংল্যান্ড গিয়েছিলেন বাউল দুর্বিণশাহ। এসময়ও তাঁর অন্যতম সফর সঙ্গী ছিলেন বাউলসাধক শাহ আবদুল করিম। সেখানে তার গানের কথা ও সুরে বিমোহিত হয়ে সঙ্গীত প্রেমীরা তাকে ‘জ্ঞানের সাগর’ আর শাহ আবদুল করিমকে ‘রসের নাগর’ উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন।
দুর্বিণ শাহের অন্যতম গানগুলোর মধ্যে রয়েছে- পরদেশীরে দূর বিদেশে ঘর, নব যৌবন আষাঢ় মাসে, তোমার মতো দরদী কেউ নাই, বন্ধু যদি হইতো নদীর জল, বেলা গেল সন্ধ্যা হল আর কি বাকি আছে বল, আমি জন্মে জন্মে অপরাধী তোমারই চরণে রে- ইত্যাদি।
এই বাউলদের সাধনার পদ্ধতি এবং এ সম্পর্কিত পদাবলিগুলো তাঁদের গোপন-সাধনার অংশবিশেষ হিসেবে মনে করতেন। কারণ তিনি জানতেন, সব তত্ত্ব সবখানে প্রকাশ করা উচিত নয়। তাতে সমাজে বিপত্তি ঘটবে। কারণ বকধার্মিক যুগে যুগে ছিল। তাই বাউলেরা মহান স্রষ্টার গভীর তত্ত্বসমৃদ্ধ গানগুলি কেবল নিজেদের মধ্যেই আলোচনায় সীমাবদ্ধ রাখতেন। তবে সিলেট ও নেত্রকোনা অঞ্চলের বাউলেরা ছিলেন কিছুটা ভিন্ন। এসব গান মানুষের বিনোদনের জন্য মঞ্চেও পরিবেশন করা হতো। ফলে গোপন-তত্ত্ব সমৃদ্ধ এসব পদাবলির ভাবার্থ শ্রোতাদের কেউ কেউ বুঝতেন, আবার কেউ বুঝতেন না।
দুর্বিন শাহর গানে দেহতত্ত্ব এবং বাউল-দর্শনের গভীরতা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তাঁর গান অধ্যাত্মবাদ সম্পর্কিত শব্দগুলো ধারণ করে বস্তুবাদী চেতনারই প্রকাশ ঘটিয়েছে। এমনকি ধর্মীয় বিদ্বেষ ও হানাহানির বিপরীতে তাঁর গান এক সমন্বয়বাদী চেতনার উৎস। মানবতাবাদ তাঁর গানের অন্যতম অবলম্বন।
বাউল-অনুরাগী কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন ‘বাউল সাহিত্যে বাউল সম্প্রদায়ের সেই সাধনা দেখি, এ জিনিস হিন্দু-মুসলমান উভয়েরই।
বাউল দুর্বিন শাহের জন্ম ও মৃত্যু:
১৯২০ সালের ২ নভেম্বর ছাতকের সুরমা নদীর উত্তর পারে নোয়ারাই গ্রামের তারামনি টিলা এলাকায় জন্মেছিলেন দুর্বিন শাহ। তবে এই তারামনি টিলা একসময় দুর্বিন শাহের নামের সঙ্গে যুক্ত হয়ে সবার কাছে দুর্বিন টিলা নামে পরিচিতি পায়। তাঁর পিতা সফাত আলি শাহ ছিলেন একজন সুফি সাধক এবং মা হাসিনা বানু ছিলেন একজন পিরানী। পিরানী শব্দের অর্থ- পীরান নামক এক ব্যক্তির বংশধর।
ফলে পারিবারিক ভাবে ছোটবেলা থেকেই সঙ্গীতচর্চার বেড়ে উঠেছেন গুণী এই মানুষটি। কিন্তু মাত্র সাত বছর বয়সে বাবা হারান দুর্বিন শাহ। ফলে ছোটবেলা থেকেই জীবন সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত হতে হয় তাঁকে। কিন্তু শত সংগ্রামেও সংগীত চর্চা ও সত্যের সন্ধানে আরাধনা কখনো বন্ধ হয়নি তাঁর। ১৯৪৬ সালে সুরফা বেগমকে জীবনসঙ্গী হিসেবে ঘরে তোলেন দুর্বিন শাহ। ১৯৭৭ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি মাত্র ৫৭ বছর বয়সে নিজ বাড়িতে মৃত্যুবরণ করেন তিনি।
( প্রিয় পাঠক, দুর্বিন শাহের জীবনী পড়তে এই লিংকে প্রবেশ করে বিশেষ মূল্যহ্রাসে বই সংগ্রহ করতে পারেন)