বাংলা সাহিত্যের অন্তরের কিছু কথা

।বিপ্লব রায়।

বাংলা সাহিত্য সৃষ্টির পর থেকে চিরকালই বদলে চলেছে তার রূপ ও হৃদয়।  হাজার বছরে বাঙলার স্রষ্টাদের কলমের ধারায় একের পর এক সৃষ্টি হয়েছে নতুন নতুন সৌন্দর্য।  জ্বেলেছেন নতুন নতুন দীপ।

মধ্যযুগের কবিরা লিখেছেন মঙ্গল কাব্য, লিখেছেন পদাবলী।  ঊনিশ শতকে বাংলা হয়ে ওঠে আরো প্রাচুর্য়ময়।  আর বিংশ শতাব্দীতে তা হয়ে ওঠে আরো অসীম।  যার শোভার কোনো শেষ নেই।

বাঙলা সাহিত্যের দ্বীপ জ্বেলেছেন লুইপাদ, কাহ্নপাদ, বড়ুচণ্ডিদাশ, মুকুন্দরাম, বিদ্যাসাগর, বিদ্যাপতি, মধুসূদন দত্ত, বিহারী লাল চক্রবর্তী, কবি ভারতচন্দ্র, আলাওল, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশ ও বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়সহ বহু মহাগুণীজন।

বাঙলা সাহিত্য এমন এক প্রাণ, যার রস আস্বাদন করলে অমৃত স্বাদের সন্ধান মেলে।  উপলব্ধি হয় যেন চারদিকে জ্বলছে হাজার তারার আলো।  মনে হয় চারদিক ভরে ওঠে হাজার প্রদীপের আলোয়।  এ যেন এক আলোর পৃথিবী। আলোর ঝর্ণাধারা।

ইতিহাস বলে, বাঙলা সাহিত্য শুরুর দিকে উঁচু শ্রেণির মানুষের কাছে সমাদৃত হয়নি।  তারা বাঙলাকে বাদ দিয়ে সংস্কৃত ভাষাকেই বেশি গ্রহণ করেছেন।  তবে সাধারণ মানুষ বাঙলা সাহিত্য চর্চা থেকে থেমে থাকেনি।  তারা বাঙলাকেই গ্রহণ করেছেন মনপ্রাণে।  তাই ধীরে ধীরে সঙ্গোপনে এগিয়ে চলেছে বাংলার রাজত্ব।

আজ বাঙলা সাহিত্যের বয়স এক হাজার বছর ছাড়িয়ে গেছে।  চর্যাপদ হচ্ছে বাঙলা সাহিত্যের প্রথম কাব্যগ্রন্থ।  যা রচিত হয়েছিল দশম শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যে।  চর্যাপদ গ্রন্থটি তৎকালীন কবিরা শুধু নিজেদের সাধনার গোপন কথা বোঝার জন্যই রচনা করেছিলেন।  সবার জন্য নয়।  তারা ছিলেন বৌদ্ধ সাধক।

বর্তমানে বাঙলা সাহিত্যে গদ্য ও পদ্য দুটি রূপ থাকলেও আগে সবই ছিল পদ্য বা কবিতা।  তৎকালীন কবি ও সাহিত্যিকরা ভাষার ছন্দে যেন নৃত্য করতেন।  ছন্দই ছিল তাদের প্রাণ।  গদ্য বলতে তেমন কিছুই ছিল না।  কারণ তারা জানতেন, ছন্দের একটা সম্মোহনী শক্তি আছে।  যা গদ্যের নেই।  যদিও বর্তমানে গদ্যের সৌন্দর্য অপরিসীম।

যদিও দিনে দিনে ভাষার সৌন্দর্য দিনে দিনে বদলেছে।  এখনো বদলাচ্ছে।  কারণ সবাই একই বাঙলা উচ্চারণ করে না।  তারা সহজকেই বেছে নেয়।  একটু পেছনের দিকে তাকালে দেখা যাবে, আগে যেমন সাধু ভাষার ব্যবহার ছিল সর্বত্র, এখন কিন্তু তা নেই।  এখন চলিত ভাষা সবার প্রিয়।  সহজবোধ্য।

উদাহারণ হিসেবে বলা যায়, আগে মানুষ ‘চন্দ্র’ বলতো।  এরপর ধীরে ধীরে তা হয়ে গেল চন্দ।  এখন সেই চন্দকে আমরা চাঁদ বলে জানি।  একই ভাবে কর্ণ হয়ে গেল কন্ন।  পরে সহজ রূপ হয়ে গেল কান।

বাঙলা ভাষাকে তিনটি স্তরে ভাগ করা হয়েছে।  প্রথম স্তরটি ছিল প্রাচীন বাঙলা ভাষা।  যার প্রচল ছিল ৯০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১২০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত।  এরপর ১২০০ থেকে ১৩৫০ পর্যন্ত বাঙলা ভাষার কোনো নমুনা পাওয়া যায়নি।  ১৩৫০ থেকে ১৮০০ সাল পর্যন্ত মধ্যযুগ আর ১৮০০ সালের পর বাঙলা ভাষায় শুরু হয় আধুনিকতার ছোঁয়া।

সম্রাট আকবরের সভাকবি আবুল ফজলের বর্ণনায় বলা হয়, বঙ্গ ও আল শব্দের সম্মিলনে বাঙ্গাল শব্দের উৎপত্তি।  যা থেকে আজকের এই বাঙলা ভাষা।

অর্থাৎ বঙ্গ মানে বাঙলা আর আল শব্দটি এসেছে খেতের আল থেকে।  কারণ এই দেশটি বর্ষাকালে ডুবে থাকে।  তখন খেতে আল বা বাঁধ দিতে হয়।  তাই বঙ্গ এই শব্দের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে আল।

মধ্যযুগে বাঙলা সাহিত্যে যুক্ত হয় বৈষ্ণব পদাবলী। এ কবিতার প্রধান চরিত্র রাধা-কৃষ্ণ।  রাধা-কৃষ্ণের প্রেম বাংলা সাহিত্যকে আরো মহিমান্বিত করেছে।

এছাড়া প্যারিদাস মিত্রের ‘আলালের ঘরের দুলাল’, মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘মেঘনাদ বধ’ কাব্য, সনেট, কৃষ্ণ কুমারী নাটক, বুড়ো শালিকের ঘারে রোঁ- বাঙলা সাহিত্যকে আরো সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন।  এরপরে এসেছেন বিহারী লাল চক্রবর্তী, দীনবন্ধু মিত্র, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কায়কোবাদ, মীর মোশাররফ হোসেন।  তাদের পরে এসেছেন-মোহিত লাল মজুমদার, শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দেব, অমিয় চক্রবর্তী, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, বিভূতি ভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়।  তাঁরা সবাই বাঙলা সাহিত্যের অগ্রনায়ক।

বলে রাখা ভালো, ১৯০৭ সালে পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপালে গিয়ে সেখানের রাজ দরবার থেকে চর্যাপদ আবিস্কার করে নিয়ে আসেন।  এরপর এ নিয়ে টানাটানি শুরু হয়েছিল।  মূলত: এই চর্যাপদই বাঙলা সাহিত্যের আলোকবর্তিকা।

এই চর্যাপদে ছিল ৪৬টি পূর্ণ কবিতা বা গানের সংকলন ও একটি ছেঁড়া কবিতা।  তাই সবমিলিয়ে এতে কবিতা আছে সাড়ে ছেচল্লিশটি।  যা লিখেছিলেন ওই সময়ের ২৪ জন বাউল কবি।  যাঁদের কোনো ঘরবাড়ি ছিল না।  তাদের নাম ছিল লুইপাদ, কাহ্নপাদ, সরহপাদ, চাটিল্লপাদ, ডোম্বিপাদ, শবরপাদ।  এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অর্থাৎ ১২টি কবিতা লিখেছেন কাহ্নপাদ। তাদের লেখনিতে ছিল বাঙলার সমাজের ছবি।  ছিল গরিব মানুষের বেদনার ছবি, কিছু সুখের গল্প।  তবে এগুলো সহজবোধ্য ছিল না।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top