
বাণীবিতান ডেস্ক।।
বৈচিত্র্যময় জীবনের সব শেষে যেমন এক মধুর অনুভূতি চায় মানুষ, প্রকৃতিতেও বসন্তঋতু ঠিক তেমনি। প্রকৃতি তখন খুলে দেয় তার দখিন-দুয়ার। চারিদিকে তখন বইতে থাকে ফাগুন হাওয়া। এই হাওয়ায় দোলে প্রতিটি নর-নারীর হৃদয়ে ঢেউ খেলে যায় যৌবনেরই গান। মনে সৃষ্টি হয় ভালোবাসার নতুন উন্মাদনা। তাইতো ঋতুর রানীও বলা হয় ঐশ্বর্যধারী বসন্তকে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও এই বসন্ত নিয়ে সৃষ্টি করেছেন অসংখ্য গান ও কবিতা। এর মধ্যে
বসন্তে ফুল গাঁথল আমার জয়ের মালা।
বইল প্রাণে দখিন হাওয়া আগুন-জ্বালা॥
এছাড়া, ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান,
আমার আকুলহারা প্রাণ
আমার বাঁধন ছেঁড়া প্রাণ…
অথবা
মাধবী হঠাৎ কোথা হতে এল ফাগুন-দিনের স্রোতে।
এসে হেসেই বলে, “যা ই যা ই যাই।’
পাতারা ঘিরে দলে দলে, তারে কানে কানে বলে,
“না না না।’
আসলে বসন্ত মানেই হৃদয়ের এক বিশাল পূর্ণতা। বসন্ত মানেই নতুন প্রাণে সুরের ছন্দ। কচিপাতায় আলোর নাচন। বসন্তের এই দিনে গ্রামের বাড়িগুলোতে দূর থেকে বাতাসে ভেসে আসে কোকিলের অমৃত কণ্ঠ। অশোক-পলাশ-শিমুল গাছে আসে নতুন ফুল। গাছগুলো ভরে ওঠে নতুন পাতায়। রাধাচূড়া-কৃষ্ণচূড়া গাছগুলোর ফুলে ফুলে হয়ে ওঠে কল্পিত প্রেমিক। যার ছায়ায় বসে গল্পে মেতে ওঠে প্রেমিক যুগল। মেয়েদের হলুদ বা বাসন্তি রঙা লাল পেড়ে কিংবা লাল পাড়ের সাদা শাড়ি,গলায় গাঁদা ফুলের মালা, কানে চন্দ্রমল্লিকা-গোলাপ-জারবারা-রজনীগন্ধা ও কেশে দোলানো ফুলের ঝঙ্কার। ছেলেরা পরে পাঞ্জাবি। এরপর এই গাছের ছায়ায় প্রেমিক যুগল হারিয়ে যায় প্রেমের অবগাহনে। এটাই যেন বসন্তের এক অনবদ্য সৃষ্টি।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, বসন্ত উৎসবের আদি উতপত্তি হচ্ছে ফাল্গুনের দোলযাত্রা। কারণ প্রতি বছর ফাল্গুনের পূর্ণিমা তিথিতে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা রাধা-কৃষ্ণকে দোলনায় বসিয়ে এ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পূজা-পার্বণের আয়োজন করেন। যা পবিত্র হোলি উতসব হিসেবেও পরিচিত। এ উতসবে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ হোলি খেলায় মেতে ওঠেন।
ভারত উপমহাদেশের পূর্বাঞ্চলের প্রাচীন আর্য জাতির হাত ধরে এই উৎসবের জন্ম। খ্রিস্টের জন্মেরও বেশ কয়েকশো বছর আগে থেকে উদযাপিত হয়ে আসছে দোল উৎসব। ধারণা করা হয়-খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ অব্দে পাথরের উপর খোদাই করা এক পাথরে পাওয়া গেছে এই উৎসবের নমুনা। এছাড়া সনাতনী ধর্মাবলম্বীদের পবিত্র গ্রন্থ বেদ ও পুরাণেও উল্লেখ রয়েছে এই উৎসবের কথা। প্রথমদিকে ইংরেজরা ভারতবর্ষে এসে এই উৎসবকে রোমান উৎসব ‘ল্যুপেরক্যালিয়া’র সাথে গুলিয়ে ফেলেছিল। অনেকেই আবার একে গ্রিকদের উৎসব ‘ব্যাকানালিয়া’র সাথেও তুলনা করতেন।
ভারতের পুরীতে ফাল্গুন মাসে অনুষ্ঠিত দোলোৎসব অনুকরণ করে বাংলাতেও সৃষ্টি হয় এই উৎসবের রেওয়াজ। বসন্তকালে রাসমেলা বা রাসযাত্রারও প্রচলন হয় মধ্যযুগে। নবদ্বীপে রাসমেলার উৎপত্তি। বসন্তকালে বাংলাদেশের খুলনাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে রাসমেলা হয়ে থাকে। সেখানে কীর্তনগান ও নাচের আসর বসে থাকে। এছাড়া প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলায় বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা ফাল্গুনী পূর্ণিমা উদযাপনের মাধ্যমে বসন্তকে বরণ করতেন।
এর ধারাবাহিকতায় ১৫৮৫ সালে সম্রাট আকবর বাংলা বর্ষপঞ্জী হিসেবে আকবরি সন বা ফসলী সনের প্রবর্তন করার সময় প্রতি বছর শুরু হয় ১৪টি উৎসব পালনের রীতিও। এর মধ্যে অন্যতম ছিল বসন্ত উৎসব। সেসময় বাংলার সকল মানুষই বসন্ত বরণে বিভিন্ন লোকজ উৎসব ও মেলায় অংশগ্রহণ করে উদযাপন করতেন। যদিও তখনকার প্রাণের বসন্ত এখন রূপান্তরিত হয়েছে বাণিজ্যিক অনুষ্ঠানে।
বাংলাদেশের অধিকাংশ জেলায় নানা শ্রেণি ও বয়সের মানুষের অংশগ্রহণে এখন নানা আয়োজনে অনুষ্ঠিত হয় বসন্তের প্রথম দিন তথা পহেলা ফাল্গুন। বসে গ্রামীণ মেলা। এ উতসব এখন বাঙালির সর্বজনীন। তবে এর পেছনে সবচেয়ে বেশি অবদান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের একদল শিক্ষার্থীর। ১৯৯১ সালে স্বৈরশাসক এরশাদের শাসনামলে কোনোরকম পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়াই বসন্ত বরণ উৎসবের আয়োজন করেছিলেন তারা। এরপর এই অনুষ্ঠানের গ্রহণযোগ্যতা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। প্রকৃত মানুষ বুঝতে শুরু করে বাঙালির ভাষা। বাঙালির অনুভূতি। এভাবে ১৯৯৪ সাল থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বসন্ত উৎসব উদযাপন শুরু হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলায়। চারুকলার বকুলতলায় বসন্ত উতসব করতে গঠন করা হয় জাতীয় বসন্ত উৎসব উদযাপন কমিটি। সেই থেকে আজো এই ধারা বহিছে অবিরত।
প্রিয় পাঠক, প্রেমের উপন্যাস পড়তে এই লিংকে প্রবেশ করে `মহাশ্বেতা দেবীর প্রেমের গল্প‘ বইটি সংগ্রহ করতে পারেন। একই সঙ্গে আপনি বাণীবিতান ডটকমে লিখতেও পারেন। আপনার ভালো লেখাটি পাঠিয়ে দিন contact@banibitan.com এই ঠিকানায়।