
বিপ্লব রায়।।
আমরা সামাজিক ও রাজনৈতিকসহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ড পরিচালনার ক্ষেত্রে অনেককিছুই বয়কট করি। বাংলায় যার অর্থ বর্জন। কিন্তু এই বয়কট শব্দটির একটি ইতিহাস আছে। যা হয়তো সবার জানা নেই। যাঁদের জানা নেই, তাদের জন্যই বয়কট’ শব্দের উৎপত্তি নিয়ে এবারে আলোচনা।
কোনকিছু বয়কট করলেই আমরা এড়িয়ে চলা বা একঘরে করে ফেলা বুঝি। আরো একটু বাড়িয়ে বললে বলা যায়, সকল সামাজিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার মানেই হচ্ছে বয়কট। বয়কট শব্দটি ইংরেজি হলেও আমরা এখন প্রচলিত বাংলাতেই এই শব্দটি গেঁথে নিয়েছি। কিন্তু সবাই হয়তো জানি না, এই বয়কট শব্দটির নেপথ্যেও যে কোনো গল্প আছে।
আর এই শব্দের পেছনের মানুষটির নাম চার্লস কানিংহাম বয়কট। এক বিচিত্র প্রকৃতির মানুষ ছিলেন তিনি। যাঁর জন্ম ইংল্যান্ডের নরফোকের এক গ্রামে। খ্রিস্টিয় ১৮৩২ সালে। মৃত্যু ১৮৯৭ সালে। তাঁর কাজকর্ম এতই বিতর্কিত ছিল যে, একসময়ে তাঁকে একঘরে করে রেখেছিলেন আয়ারল্যান্ডের মায়ো কাউন্টির বর্গাচাষিরা। এক পর্যায়ে তাদের দেশের স্থানীয় বাসিন্দারাও তাকে বর্জন করে। আর তখন থেকেই তার নাম দিয়েই প্রচলন করা হয় আজকের এই বয়কট শব্দের। পরবর্তীতে এই শব্দ শুধু আয়ারল্যান্ড নয়, বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে। কালক্রমে যা যুক্ত হয় বিশ্বজুড়ে সব অভিধানেও।
বয়কট ছিলেন তৃতীয় আর্ল আর্নে (সম্ভ্রান্ত ইংরেজ ভূমিমালিকদের পদবি)। সহজ ভাষায় বলা যায় ব্রিটিশ এস্টেট ম্যানেজার। জন ক্রিকটনের প্রতিনিধি হিসেবে মায়ো কাউন্টির খাজনা আদায় করতেন তিনি। ১৮৮০ সালে ওই দেশে ফসলের ফলন কম হওয়ায় চাষিদের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল। তাই ১০ শতাংশ খাজনা মওকুফের ঘোষণা দিয়েছিলেন জন ক্রিকটন। কিন্তু চাষিদের দাবি ছিল ২৫ শতাংশ মওকুফের। তবে সেই দাবি অগ্রাহ্য করেন লর্ড আর্নে। এতে চাষিদের সঙ্গে জন ক্রিকটনের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়। তাই চাষিদের দমাতে এক কূটকৌশল গ্রহণ করে ১১ জন বর্গাচাষিকে উচ্ছেদের চেষ্টা করেন বয়কট। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন অন্য চাষিরা। এর অংশ হিসেবে বয়কটের গৃহকর্মী থেকে দিনমজুর সবাই কাজ বর্জন করেন। ব্যবসায়ীরা সম্পর্ক ছিন্ন করে নেন। এভাবে এক সময় স্থানীয় ডাকঘরের পিয়নও চিঠি সরবরাহ বন্ধ করে দেন। এতে আরো বিপাকে পড়ে যান বয়কট। টাকা ও ক্ষমতার জোড়ে অন্য এলাকা থেকে চেষ্টা করেন অন্য এলাকা থেকে লোক এনে চাষের কাজ করানোর। তবে তাতে লাভ হয়নি মোটেও। ফলে আর্থিকভাবে বেশ ক্ষতির শিকার হন বয়কট। আর এ খবর চারদিকে জানাজানি হওয়ার পর বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তা ছাপা হয়। এভাবে বয়কটের নাম অনুসারে একসময় মানুষ কাউকে বর্জন করলেই বয়কট নাম দিয়ে দিতেন। অমুকে এই অনুষ্ঠান থেকে বয়কট। অথবা অমুন অনুষ্ঠান বয়কট করা হলো। কালক্রমে সেই বয়কটই অভিধানে যুক্ত হয়ে যায় বর্জন করা হিসেবে।
পেশাগত জীবনে একজন সেনা কর্মকর্তা ছিলেন বয়কট। ১৮৪৯ সালে ৪৫০ পাউন্ডে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর ক্যাপটেন পদ পেয়ে যান তিনি। তখনকার দিনে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে পদ এভাবে বিক্রি হতো। পরে পদাতিক বাহিনীতে কমিশনপ্রাপ্ত হয়ে যোগ দেন ৩৯তম ফুট রেজিমেন্টে। সেখানে কিছুদিন কাজ করার পর রেজিমেন্টের সঙ্গে বদলি হয়ে বয়কট চলে যান উত্তর আয়ারল্যান্ডের বেলফাস্টে। পরে সেখানেই শুরু হয় বয়কটের আয়ারল্যান্ডের জীবন।
(তথ্যসূত্র- প্রথম আলো অনলাইন, ২২ নভেম্বর ২০২০)