প্রসঙ্গ: নজরুল ও শ্যামা সংগীত

 

কাজী নজরুল ইসলামের শ্যামা সংগীত রচনা
কবি কাজী নজরুল ইসলাম

বিপ্লব রায়।।

সঙ্গীতজ্ঞ অনেকেই স্বীকার করেন, কবি নজরুল যত গভীর ভাবে শ্যামা সংগীত রচনা করেছেন, সে জন্য হিন্দু সমাজ তাঁর কাছে চির কৃতজ্ঞ। কারণ এই গানে কত গভীর ভাবে তিনি মায়ের কল্পিত রূপ ও তাঁর প্রতি ভক্তি দিয়ে শব্দের মালা গেঁথে সুরারোপ করেছেন, তা তাঁর গান শুনলেই অনুধাবন করা যায়। তাইতো কাজী নজরুল ইসলামকে বাদ দিয়ে শ্যামা সঙ্গীত চিন্তাই করা যায় না।

“ভক্তি, আমার ধুপের মত,
ঊর্ধ্বে উঠে অবিরত।
শিবলোকের দেব দেউলে,
মা’র শ্রীচরণ পরশিতে।”

এই গানের প্রতিটি শব্দ এত গভীর, যা পরিমাপ করা সাধারণের পক্ষে অসম্ভব। কত আবেগ, কত শ্রদ্ধা থাকলে একজন কবি তাঁর এমন ভাষা ব্যবহার করতে পারেন। মূলত: সূর্য যেমন কখনো স্থান ভেদে আলাদা আলো দেয় না। যেমন তার জাগতিক কোনো ধর্ম নেই। কবি নজরুল ইসলামও তেমন এক মহাসূর্য। যিনি কখনো ধর্মের নামে সংকীর্ণতার বেড়াজালে আবৃত হননি। তাই বলে কবির সমালোচনা করতে ছাড়েননি তৎকালীন মৌলবাদী হিন্দু ও মুসলিম সমাজের লোকজন। হিন্দুদের একটি গোষ্ঠী ভাবতো কাজী নজরুল ইসলাম মুসলমান। আর একদল মুসলিম বলতো- কাজী নজরুল ইসলাম প্রমীলা দেবীকে বিয়ে করে শ্যামা সংগীত রচনা করেছে। তাই তিনি খাঁটি মুসলিম নয়। ওই সমাজের মুসলিমদের একটা শ্রেণি নজরুলকে কাফির আখ্যা দিতেও কুণ্ঠাবোধ করেনি। তাইতো নজরুল ‘আমার কৈফিয়ৎ’এ লিখেছিলেন-

‘মৌ-লোভী যত মৌলবী আর ‘মোল্লারা ক’ন হাত নেড়ে,
দেব-দেবী নাম মুখে আনে, সবে দাও পাজিটার জাত মেরে!’

উপমহাদেশের সাহিত্য অঙ্গনে কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে যত সমালোচনা হয়েছে, তা অন্য কোনো কবি-সাহিত্যিকদের ক্ষেত্রে হয়নি। কারণ নজরুল পবিত্র কোরান শরীফের পাশাপাশি হিন্দু শাস্ত্রও গভীর ভাবে অধ্যায়ন করেছেন। শ্যামা মায়ের প্রতি তাঁর যে গভীর দুর্বলতা ছিল, তা শ্যামা সংগীতই তার প্রমাণ। আর এজন্যই বার বার তীব্র আক্রশের মুখে পড়তে হয়েছে নজরুল ইসলামকে। এক সময়ে পূর্ববঙ্গের বেতারেও নজরুলের শ্যামাসঙ্গীত সম্প্রচার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ছিল।

বিশিষ্ট সংগীতজ্ঞ ড. করুণাময় গোস্বামী বলেছেন, শ্যামা সংগীতকে কবি নজরুল ইসলাম যে গভীরতায় উচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত করে নান্দনিক রূপ দিয়েছেন, তা রামপ্রসাদ সেন বা কমলাকান্ত ভট্টাচার্যের গানে পাওয়া যায় না। কারণ কবি কাজী নজরুল ইসলাম গীতা-পুরাণসহ সব শাস্ত্র গভীর ভাবে অধ্যায়ন করে তার রস আস্বাদন করতে পেরেছিলেন। তাই শ্যামা সংগীতকে এত উচ্চতায় নিয়ে যেতে পেরেছেন।

কবি কখনো লিখেছেন, ‘আমার কালো মেয়ে রাগ করেছে, তারে কে দিয়েছে গালি? কখনো প্রশ্ন করেছেন, ‘মা হবি না মেয়ে হবি।’ কখনো অভিমানে গেয়েছেন—বলরে জবা বল কোন সাধনায় পেলি রে তুই শ্যামা মায়ের চরণতল?

সংগীতজ্ঞদের তথ্যমতে আনুমানিক ১৭২০-১৭৮২ খ্রিস্টাব্দের দিকে সাধক কবি রামপ্রসাদ সেন এই শ্যামা সংগীত রচনা করেছিলেন। এই সংগীতকে শাক্ত পদাবলীও বলা হয়। খ্রিস্টিয় দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতকের দিকে বৈষ্ণব ধর্মের পাশাপাশি শাক্ত ধর্মের উদ্ভব হয়েছিল। এরপর অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি শাক্তগীতি চর্চার একটি ধারার প্রচলন হয়। এ সংগীতে পুরাণে বর্ণিত ভয়ঙ্করী কালীকে তিনি স্নেহবাৎসল্য মাতৃরূপে উপস্থাপন করেছেন। তাই শ্যামা সংগীতকে অনেকে রামপ্রসাদী গানও বলে থাকেন। কারণ এই গানের কথা, সুর ও গায়কীতে এক স্বাতন্ত্র বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যা অন্যসব গানের চেয়ে আলাদা। কবি নজরুলের শ্যামা সংগীতে ফুটে উঠেছে মায়ের সঙ্গে ছেলের মান-অভিমানের প্রবলতা।

কবি নজরুল বলতে গেলে সনাতনী সব শাস্ত্র অধ্যায়ন করেছেন। তা শ্যামা সংগীতসহ বিভিন্ন রচনার মধ্যে সুস্পষ্ট ভাবে ফুটে উঠেছে। যেমন- বিদ্রোহী কবিতায় তিনি বেদ, উপনিষদসহ বিভিন্ন গ্রন্থ ও চরিত্রের প্রবেশ ফুটিয়ে তুলেছেন।

শক্তির প্রভাব হিসেবে মহাকাল বা কালীশক্তি তাঁর কবিতায় জেগে ওঠে। তিনি শ্যামা মায়ের উদ্দেশে লিখেছেন ‘আমার কালো মেয়ের পায়ের তলায় ’, ‘শ্মশানে জাগিছে শ্যামা মা’, ‘বল্ মা শ্যামা বল্ তোর বিগ্রহ কি মায়া জানে’,‘শ্যামা বলে ডেকেছিলাম, শ্যাম হয়ে তুই কেন এলি। এরকম অসংখ্য কালজয়ী শ্যামা সঙ্গীত লিখেছেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম। প্রতিটি গানে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন শ্যামা মায়ের শক্তি ও স্নেহের মাহাত্ম্য তুলে ধরেছেন মায়ের কাছে সন্তানের কত আবদার! তাইতো তিনি লিখেছেন- আমার কালো মেয়ে রাগ করেছে, কে দিয়েছে গালি।/ রাগ ক’রে সে সারা গায়ে মেখেছে তাই কালি।

কাজী নজরুল ইসলাম মূলত: নজরুল প্রখ্যাত গায়ক কৃষ্ণচন্দ্র দে’র অনুরোধে শ্যামা সংগীত রচনা শুরু করেছিলেন। তাঁর অনুপ্রেরণায় নজরুল রচনা করেছিলেন, ‘আর লুকাবি কোথায় মা’, ‘আমার কালো মেয়ের পায়ের তলায়’।

বলা যায়, বাংলা গানের ইতিহাসে যে সব শ্যামা সংগীত কালজয়ী গৌরব লাভ করেছে, তারমধ্যে নজরুল রচিত গানের সংখ্যাই বেশি। তাই কাজী নজরুল ইসলাম শ্যামা সংগীতের জগতেও এক মহাবিস্ময়।

তথ্যঋণ :
ড.মাধুরী সরকার : গানের ভুবন

 

কবি নজরুলের সংগীত ভাবনা নিয়ে পড়তে চাইলে এই লিংকে প্রবেশ করে সংগ্রহ করতে পারেন ‘ কাজী নজরুল ইসলামের সংগীত ভাবনা’ বইটি।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top