ডিপ স্টেট’ বা ‘গুপ্তরাষ্ট্র’ কী?

বাণীবিতান ডেস্ক।।

পৃথিবীর বেশির ভাগ মানুষই সাধারণ। তাঁরা সব সময় সামনে যা দেখেন, তাই নিয়েই ভাবেন। রাষ্ট্র, আইন, রাজনীতির কূটচাল এসব নিয়ে অনেক কিছু বর্তমান জমানায় অনেকে বুঝলেও করার কিছু থাকে না। আমরা সাদা চোখে বিশেষ করে বাংলাদেশে একটি গোষ্ঠীর রাজনীতি, ক্ষমতায় যাওয়ার চেষ্টা, কারো ক্ষমতায় থাকার চেষ্টা এসব দেখতেই অভ্যস্ত। কিন্তু এসব রাঘব বোয়ালদেরও নেপথ্যে একটি স্বার্থান্বেসী গোষ্ঠী আছে। যারা আমাদের চোখের সামনের বোয়ালগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে। তেমনি একটি গোষ্ঠীর নাম ডিপ স্টেট। এই ডিপ স্টেট গোটা পৃথিবী নিয়ন্ত্রণ করে।

‘‘ডিপ স্টেট নিজেদের আরাম-আয়েশ-নিরাপত্তার জন্য মাটির নিচে বিশেষ কায়দা করে রেখেছে। সেখানে থাকার ব্যবস্থা এমনই যে, ব্লুমন্টের কাছে মাউন্ট ওয়েদারে মাটির নিচে এক বিশাল শহর তৈরি রাখা হয়েছে। বিপদের সময় ডিপ স্টেটের অধিবাসীরাই সেখানে থাকবে, জনগণ নয়। আণবিক যুদ্ধও হলেও তাদের টিকিটিও ছুঁতে পারবে না কেউ।’’

ডিপ স্টেট কী? আরো বুঝতে হলে একটু গভীরে যেতে হবে। ডিপ স্টেট হচ্ছে-রাষ্ট্রের মধ্যে আরেকটি সমান্তরাল রাষ্ট্র। যে রাষ্ট্রের কুশীলবরা কখনো সামনে আসেন না। পর্দার অন্তরালে থেকেই নিজেদের কার্যসিদ্ধি করে। তারা মূলত: বিভিন্ন দেশে বড় মাফিয়াদের এজেন্ট বানিয়ে ওই দেশের লোকদের মধ্যে দাঙ্গা বাঁধিয়ে রাখে। অর্থাৎ সোজা বাংলায়, ওদের কাছ থেকে স্বার্থ নিয়ে কতিপয় লোক নিজের দেশে আগুন দেয় আর সেখানে আলু পোড়া দিয়ে খায় ডিপ স্টেট

ডিপ স্টেট কোনো সাংবিধানিক বা বিধিবদ্ধ কাঠামো নয়। এরা এমন একটি মাফিয়া গ্রুপ, যারা রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যে সক্রিয় থেকে বিপুল ক্ষমতা ভোগ করে। তারা তাদের স্বার্থে রাষ্ট্র ও সরকারের ক্ষমতা ব্যবহার করে কাজ করে আর দায় পড়ে রাষ্ট্র ও সরকারের। প্রচলিত বাংলায় বলতে গেলে- ডিম পাড়ে হাঁসে, খায় বাগদাশে- ঠিক এরকম অবস্থা।

ডিপ স্টেটের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে যুদ্ধ বাঁধানো। তারা নানা কায়দা করে বিভিন্ন রাষ্ট্রের মাঝে যুদ্ধ, অভ্যন্তরীণ সংঘাত, সামাজিক অশান্তি বাঁধিয়ে দিয়ে এর ফলের জন্য অপেক্ষা করে। উদ্দেশ তাদের অর্থ ও ক্ষমতা লাভ।

এরা বিশ্বের যে কোনো সরকারকে যেমন ক্ষমতায় নিতে পারে, তেমনি ক্ষমতা থেকে সরাতেও পারে। তারা এতটাই শক্তিশালী যে, তাঁরা থাকেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।

উইকিতে ডিপ স্টেট’ কে ছায়া সরকার (ষড়যন্ত্র) বলে অনুবাদ করা হয়েছে। কারণ, ডিপ স্টেট কখনো জনগণ, দেশ, রাষ্ট্র এসব নিয়ে ভাবে না। তারা শুধু জানে তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকতে হবে সব। তাতে যার যা হোক। আর বলে রাখা ভালো যে, এই ডিপ স্টেটের কেউ নির্বাচিত নয়। একদল ধনাঢ্য ও মেধাবী লোক এই ডিপ স্টেটের মালিক হন। যাদের কাজ ও নেশা একটাই, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা।

জানা গেছে, ১৯৭৩ সালে ৮৭ জন ধনী, ক্ষমতাবান রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব নিয়ে ডেভিড রকফেলার এই ডিপ স্টেট বা ছায়ারাষ্ট্র গঠন করেছিলেন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল নতুন বিশ্ব গড়ে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা। যেমন- প্রেসিডেন্ট ওবামার শিক্ষক জিবনিউ ব্রেজিনস্কি এই ডিপ স্টেটের সদস্য ছিলেন। ব্রেজিনস্কি হচ্ছেন ট্রাইলেটারাল কমিশনের সহপ্রতিষ্ঠাতা। এছাড়া এই কমিশনের সদস্যদের কেউ-না-কেউ আমেরিকা-ইউরোপে ক্ষমতায় গেছেন।

ছায়ারাষ্ট্রের আধুনিক স্থপতি ডেভিড রকফেলার ১৯৭৩ সালে ৮৭ জন ধনী, ক্ষমতাবান রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব নিয়ে ট্রাইলেটারাল কমিশন তৈরি করেছিলেন। নতুন বিশ্ব গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে এরা কাজ শুরু করেন। এরা ইউরোপ-আমেরিকার বিশিষ্ট ব্যক্তি এবং এই কমিশনের সদস্যদের কেউ-না-কেউ আমেরিকা-ইউরোপে ক্ষমতায় গেছেন। যেমন জিবনিউ ব্রেজিনস্কি, যিনি প্রেসিডেন্ট ওবামার শিক্ষক ছিলেন। ব্রেজিনস্কি ট্রাইলেটারাল কমিশনের সহপ্রতিষ্ঠাতা। এই কমিশনের সদস্য লুকাস পাপাডোমস এবং মারিও মন্টি যথাক্রমে গ্রিস ও ইতালির প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। এই কমিশনের সদস্যরা বিশ্বব্যাংকে প্রেসিডেন্টদের বেশির ভাগ। বুশ, ক্লিনটন, ডিক চেনি, আল গোরও এই কমিশনের সদস্য হিসেবে বিশ্বঅর্থনীতি এবং রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করেছেন; এখনো করছেন।

মার্কিন কংগ্রেসের সাবেক সিনিয়র কর্মকর্তা মাইকেল লোফগ্রেন তার ‘দি ডিপ স্টেট : দি ফল অব দি কনস্টিটিউশন অ্যান্ড দি রাইজ অব শ্যাডো গভর্নমেন্ট’ বইয়ে লিখেছেন, “এই ছায়ারাষ্ট্রের সদস্যরাই নির্বাচনে সাহায্য করে। নির্বাচিতদের তথ্য দিয়ে তাদের নীতি ও কর্মপন্থা এমনভাবে নির্মাণ করিয়ে নেয় যেন অবশেষে তারাই এর ভোক্তা হতে পারে। অর্থাৎ এরা শাসন-শোষণ-নির্বাচন করে থাকেন নিজেদের জন্য, তবে অপরের নামে।

গত শতকের ৬০-এর দশকে দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকা ও এশিয়ার দেশগুলোতে ডিপ স্টেটের ব্যাপক উত্থান পরিলক্ষিত হয়। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ-এর সরাসরি তত্ত্বাবধানে এসব ডিপ স্টেট পরিচালিত করা হয়েছিল। অনেকগুলো উদ্দেশ্য নিয়ে এসব ডিপ স্টেট তৈরি করা হয়েছিল। সাধারণভাবে মনে হবে সরকার বিরোধী জনমতকে দমনের জন্য এসব ডিপ স্টেট তৈরি করা হয়। কিন্তু সরকারকেও নিয়ন্ত্রণের জন্য ডিপ স্টেটকে স্নায়ুযুদ্ধের সময় সিআইএ ব্যবহার করেছে।

এই ছায়া রাষ্ট্র বা ডিপ স্টেট নিজেদের প্রয়োজনীয় তথ্য-সূত্র সুবিধাগুলো নিয়ে নেয় রাষ্ট্রের অর্থ, উপযোগিতা ও সেবা ব্যবহার করেই। তারাই চক্রান্ত করে বিভিন্ন দেশে নানা অঘটন পেছন থেকে ঘটিয়ে থাকে। যেমন, নাইন ইলেভেন, লিবিয়ার গাদ্দাফি, ইরাকের সাদ্দাম হোসেনের পতন। নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করতে; তখন জনগণের অসন্তোষকে তারা ব্যবহার করে। এজন্য সব দেশেই তাদের প্রতিনিধিও থাকে। যাদের মাধ্যমে বিপুল বিনিয়োগ করে এসব বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির জন্য।

সারা বিশ্বের তথ্য সংগ্রহ করে বিশ্ব নিয়ন্ত্রণ করতে ২০০৭ সালে ১৭০ কোটি ডলার খরচ করে ইউটাহতে ১৭টি ফুটবল মাঠের সমান একটি বিশাল ভবন নির্মাণ করেছে ডিপ স্টেট। সেখানের কম্পিউটার ও সার্ভারে এক ইওটাবাইট তথ্য আছে। অর্থাৎ ৫০০ কোটি লাখ পাতায় যে তথ্য থাকে, তার সমান। অন্য কথায়, এখানে বিশ্বের প্রতিটি মানুষের তথ্য পাওয়া যাবে। এই ছায়ারাষ্ট্র ওয়াশিংটনে ৩৩টি প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করেছে। এক কোটি ৭০ লাখ বর্গফুটে অবস্থিত এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে ৮,৫৪,০০০ বেসরকারি গোয়েন্দা কাজ করে যাচ্ছে। তারা দেশের এবং বিশ্বের প্রয়োজনীয় সব প্রতিষ্ঠান ও মানুষের তথ্য অনুসরণ করে।

এই ডিপ স্টেট মূলত: জাতীয় প্রতিরক্ষা, গোয়েন্দা সংস্থা, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বিচার বিভাগ এবং অর্থ বিভাগের একাংশের সমন্বয়ে গঠিত। এরা বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে নিজেদের মাঝে গোপন ও স্বতঃস্ফূর্ত যোগাযোগ রক্ষা করে। বৈদেশিক মন্ত্রণালয়কে ইচ্ছেমতো নাটাইয়ের মতো ব্যবহার করে।

ডিপ স্টেট জনগণের সাধারণ অধিকার ছিনিয়ে নিয়ে একটি ভীতির রাজ্যে নীত করে। নিরাপত্তার নাম বলে তারা রাষ্ট্রকে নানা সংঘাতে জড়িয়ে যুক্ত করে আর্থিক সুবিধা লুটে নেয় ডিপ স্টেট।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট থিওডোর রুজভেল্ট এই ডিপ স্টেট সম্পর্কে এক প্রণিধানযোগ্য মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘প্রকাশ্য সরকারের পেছনে সিংহাসনে আসীন থাকে এক অদৃশ্য সরকার যার জনগণের প্রতি কোনো দায়িত্ব নেই ও আনুগত্যও নেই।’

ডিপ স্টেট নিজেদের আরাম-আয়েশ-নিরাপত্তার জন্য মাটির নিচে বিশেষ কায়দা করে রেখেছে। সেখানে থাকার ব্যবস্থা এমনই যে, ব্লুমন্টের কাছে মাউন্ট ওয়েদারে মাটির নিচে এক বিশাল শহর তৈরি রাখা হয়েছে। বিপদের সময় ডিপ স্টেটের অধিবাসীরাই সেখানে থাকবে, জনগণ নয়। আণবিক যুদ্ধও হলেও তাদের টিকিটিও ছুঁতে পারবে না কেউ।

বিভিন্ন অনলাইন জার্নাল ও উইকিপিডিয়া
ছবি কৃতজ্ঞতা: গুগল

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top