——–সুব্রত পুরু ।।
ছেলেবেলায় আমরা ঠাটিয়ে পড়া মুখস্ত করতাম। যার যত বেশি মুখস্ত এবং তা পরীক্ষায় খাতায় উগরানোর জোর থাকতো, সে ততবেশি ভাল ছাত্র হিসেবে বিবেচিত হতো। মাঝারিমাপের ছাত্র হিসেবে সব মুখস্ত করে উঠতে না পারলেও বাংলা-ইংরেজী রচনা মুখস্ত করেছিলাম অনেকগুলো। তার একটা ছিল ‘আমার জীবনের লক্ষ্য’। তাতে কি লেখা ছিল আজ আর মনে নেই, তবে জীবনের আটচল্লিশ বছর পেড়িয়ে এসে মনে হয়, আমার জীবনের আসলে কোনদিনই কোন লক্ষ্য ছিল না, উদ্দেশ্য ছিল না। অথবা হয়ত সেই ছোটবেলা থেকেই পাঠ্যবইয়ের বাইরের বইগুলো পড়তে পড়তে এক ফ্যান্টাসি জগতের বাসিন্দা হয়ে, লক্ষ্যহীন একটা জীবনই আমার জীবনের লক্ষ্য হয়ে উঠেছে কখন, টেরই পাইনি।
খুব ছোটবেলায় কাকী বলেছিলেন, বড় হয়ে জজ-ব্যারিস্টার হ’য়ো, অনেক টাকা হইবো। কিছু সময়ের জন্য জজ-ব্যারিস্টার হওয়ার লোভ হয়েছিল বটে, কিন্তু টেকেনি। ক্লাস ফোর কি ফাইভে স্কুল ইন্সপেক্টর ক্লাসরুমে জিজ্ঞেস করেছিলেন, কে কি হতে চায়। আমার কোন উত্তর ছিল না। বন্ধু রানা চটপট বলেছিল, ম্যাজিস্ট্রেট। আমি তখনও ম্যাজিস্ট্রেটের মানেই জানি না। বাড়ী এসে জিজ্ঞেস করে জেনেও কেন যেন একবারও মনে হয়নি, আমি ম্যাজিস্ট্রেটই হবো। এসএসসি পাশ করার পর নটরডেম কলেজে চান্স না পেয়ে বাড়ীর পাশের দেবেন্দ্র কলেজে ভর্তির সময় মনে হলো, সিএ পাসটা করে ফেলতে পারলে মন্দ হবে না। নিলাম কমার্স। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়ে সাবজেক্ট নিতে চাইলাম ম্যানেজমেন্ট। সবাই বললো, একাউন্টিং-এ ভর্তি হ’। অন্ততঃ বেকার থাকতে হবে না। ততদিনে আমার সিএ পাস করার ইচ্ছেটা মরে ভূত।
পাশ করার আগেই বন্ধুরা তাদের জীবনের লক্ষ্য ঠিকঠাক করে চাকরি-বাকরি, ধান্দা-ব্যবসা, বিদেশগমন, উচ্চতর, প্রফেশনাল পড়াশোনা প্রভৃতিতে ব্যস্ত হয়ে গেল। আমি আগের মতোই টিএসসিতে চা খাই, আড্ডা মারি, প্রতি বিকেলে শামসুন নাহার হলের সামনে প্রেম করতে যাই। সেকেন্ড ব্যাচের রানা বলেছিল, আপনার চাকরি নিয়ে কোন চিন্তা হয় না? হতো না তো! কোনমতে টেনে -টুনে পাশ করে যখন একটা চাকরির জন্য হন্যে হয়ে ঘুরি, তখনও আমার জীবনের কোন লক্ষ্য নেই, সুনির্দিষ্ট কোন উদ্দেশ্য নেই।
ঢাকা ইউনিভার্সিটি ডিবেটিং সোসাইটি’র নদী আপা আমার উস্ক-খুস্কু চুল, মুখভর্তি দাড়িগোঁফ, এলোমেলো জীবনযাপন দেখে হাসতে হাসতে বলতেন, তুই আসলে কেয়ারফুলি কেয়ারলেস্। হয়তবা। অবচেতন মনে কার কোন বোধ খেলা করে কে জানে!
বন্ধু প্রদীপের সুপারিশে স্টেপস্ টুয়ার্ডস্ ডেভেলপমেন্ট নামের এনজিও-তে কাজ করার সময় একবার প্রত্যন্ত গ্রামের স্বাবলম্বী মহিলাদের ট্রেনিং দিতে পাঠিয়েছিল কিশোরগঞ্জের হাওড় এলাকায় কয়েকদিনের জন্য। দুপুর নাগাদ সেশন শেষ হয়ে গেলে গ্রামের শেষে ধূ-ধূ মাঠের এক কোণায় এক চায়ের দোকানে বসে দুধ-চা খাই। গ্রামের আরো কিছু বুড়ো মানুষ আসে। তাদের হাতে অফুরন্ত সময়। তারা চা খায়, বিড়ি খায়, এলোমেলো গল্প করে তাদের আঞ্চলিক ভাষায়। আমি খোলা প্রান্তরের দিকে তাকিয়ে বসে থাকি। জনহীন বিস্তীর্ণ প্রান্তরে দূরে-কাছে ছড়ানো ছিটানো কিছু গরু-ছাগল। গরুগুলো লেজ দিয়ে মাছি তাড়ায়। মাথার উপরে বিশাল খোলা আকাশ, টুকরো টুকরো মেঘ, হু-হু বাতাস, বিড়ির গন্ধ, মাটির গন্ধে আমি সম্মোহিতের মতো বসে থাকি। মনে হয়, থেকে যাই। এখানেই থেকে যাই। অনেকগুলো টাকা দিয়ে বিসিএস ফরম কিনেছি। একটা মোটা ঢাউস গাইড যে ব্যাগে নিয়ে নিয়ে ঘুরছি মুখস্ত করবো বলে – আমার আর মনেই থাকে না!
এভাবে চলতে চলতেই তো আটচল্লিশ বছর গেল। একটা কাঠবেড়ালীর দিকে তাকিয়ে তার লেজের কাঁপন দেখতে দেখতে একটা দিন চলে যায় অনায়াসে। লাউয়ের মাচায় লাউফুল পাশে কালো ভ্রমর যতক্ষণ ওড়ে, ততক্ষণ কি আর চোখ ফেরানো যায়! ঐ যে আকাশের সাদা মেঘ, তারও কত ঢং! একবার মজে গেলে বৃষ্টির মতো গলে গলে আসে অতীত। কীভাবে নড়ি! মনে ভাব এলে দু’লাইন লিখে দেই ফেইসবুকে। মাসে দু’মাসে একটা দু’টো নেমতন্ন পেলে এর-ওর সাথে আড্ডা হয়, পান হয়, গলা ছেড়ে হাসা হয়। বছরে একবার নিয়ম করে একে-ওকে হাতে-পায়ে ধরে, তোষামোদ করে বলি, চলো আবার একটা নাটক নামাই। আর এভাবেই দিন কাটে, ক্ষয়ে যায় জীবনের মহার্ঘ্য সময়।
সবার আসলে জীবনের লক্ষ্য থাকে না। অধিকাংশ মানুষের জীবনের আসলে কোন উদ্দেশ্যও নেই। তবে কাউকে কাউকে এক অক্ষমতাবোধ সবসময় পোড়ায়। আমি যে আসলে কী হতে চেয়েছিলাম, এই ভাবনাতেও আজকাল বেশ অনেকটা সময় অহেতুক নষ্ট হয়!