জালাল উদ্দিন রুমি: বিস্ময়কর এক মহামানব

বিপ্লব রায়।।

সময়টা ১২৪৪ সাল। সাঁইত্রিশ বছর বয়সী জালালুদ্দিন রুমি একদিন বসে আছেন জলাধারের পাড়ে। অনেকগুলো বই পাশে রাখা। একটা বই গভীর মনোযোগ দিয়ে পড়ছেন। এমন সময় কোথা থেকে এসে এলেন একজন উষ্কখুষ্ক লোক। গায়ে মোটা কালো চাদর, ধুলোমাখা। জালালুদ্দিনকে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী পড়ছ?’ জ্ঞানগর্বী জালালুদ্দিন পড়া থেকে মাথা তুলে তাকালেন আগন্তুকের দিকে। অবজ্ঞার স্বরে বললেন, ‘এসব তুমি বুঝবে না।’ আগন্তক হেসে চুপ করে রইলেন। তারপর সব কটি বই হঠাৎ জলে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন। বইগুলো ডুবতে দেখে জালালুদ্দিন ‘হায় হায়’ করে উঠে বললেন, এ কী করলে! অমূল্য সব বই!

জালালুদ্দিনের আক্ষেপ দেখে হেসে এবার খ্যাপাটে লোকটা এগিয়ে গিয়ে জলে হাত ডুবিয়ে বই তুলে আনছেন একটা একটা করে। অবাক হওয়ার বিষয় এই যে, সব কটি বই শুকনা! এক–বিন্দু জলের স্পর্শ লাগেনি তাতে। বিস্ময়ে অভিভূত জালালুদ্দিন বলে উঠলেন, ‘এ কী করে সম্ভব?’ লোকটা এবার প্রশ্রয়ের হাসি হেসে বললেন, ‘এসব তুমিও বুঝবে না।’ সেই আগন্তক আর কেউ নন, তিনি মহাজ্ঞানী শামস তাব্রেজি। অর্থাৎ তাব্রেজের সূর্য। এক পর্যায়ে তাবরিজির সূর্যস্নানে শুষ্ক জ্ঞানের পথ পার হয়ে শামসের শিষ্য হলেন রুমি। এরপর একটানা চল্লিশ দিন দুজন বদ্ধঘরে আলোচনা করলেন। জালালুদ্দিনের রূপান্তর ঘটল। তিনি হয়ে উঠলেন প্রেমের মানুষ। রুমি ছিলেন ফার্সি ভাষার একজন মহান সুফি রহস্যবাদী এবং কবি। আধ্যাত্মিক বহু গানও রচনা করেছেন তিনি। মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমিকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় কবি হিসেবে শ্রদ্ধা করা হয়।

শিষ্যত্ব পেয়ে গভীর জ্ঞান সাধনার পর মহাজ্ঞানী জালাল উদ্দিন রুমি বলেন, ভ্রমর আর মৌমাছি একই ফুল থেকে রস সংগ্রহ করে, কিন্তু একজন ওই রস দিয়ে বিষ তৈরি করে, আরেকজন মধু। অর্থাৎ রুমি বলতে চান, সাধারণ আলেম আর তত্ত্বজ্ঞানী আলেম একই কোরআন থেকে ধর্মের ব্যাখ্যা দেন। একজন সেই ব্যাখ্যা দিয়ে বিশৃঙ্খলা ছড়ান, আরেকজন মানুষের মধ্যে প্রেম ছড়িয়ে দেন।

তিনি আরো বলেন, আল্লাহকে অর্জন করতে চাইলে আধ্যাত্মিক জ্ঞানে পারদর্শী প্রেমিক পুরুষের সংস্পর্শে গিয়ে অর্জন করতে হবে। সমাজে অনেক মানুষ বুজুর্গের বেশ ধারণ করে কিছু বুলি রপ্ত করে ফাঁদ পেতে আছে। বাহ্যিক দিক থেকে তাঁদের অনেক নামধাম থাকলেও প্রকৃতপক্ষে তাঁরা বিপজ্জনক। তাঁদের থেকে সতর্ক হতে হবে।

মহাজ্ঞানী মাওলানা রুমির এক গল্প থেকে আরো জানা যায়, এক মুদিদোকানির একটি তোতা পাখি ছিল। পাখিটি সুন্দর করে গান গাইতে পারত। তার মিষ্টি কথায় ক্রেতাদের মন ভুলিয়ে দিত। একদিন ওই দোকানি ব্যক্তিগত কাজে বাড়ি গেলে তোতা পাখি দোকান পাহারা দিতে লাগল। সেই সময়ে একটি বিড়াল ইঁদুর ধরার জন্য দোকানের ভেতর লাফ দিলে তোতা পাখিটি প্রাণভয়ে দোকানের ভেতর উড়তে শুরু করে। এতে তোতার ডানায় লেগে দোকানের তেলের বোতলগুলো পড়ে পুরো দোকানে ছড়িয়ে পড়ে।

দোকানি ফিরে এসে এটা দেখে খুব রেগে গিয়ে তোতার মাথায় সজোরে আঘাত করে। এতে পাখির মাথার সব পালক ঝরে গিয়ে টাক পড়ে যায়। এ ঘটনার পর তোতা পাখিটি মনের দুঃখে কথা বলা বন্ধ করে দেয়। দোকানি তাতে অত্যন্ত অনুতপ্ত হয়ে তোতার বুলি ফিরে পাওয়ার জন্য অনেক চেষ্টা করতে থাকে। কিন্তু পাখিটি কিছুতেই আর কথা বলে না।
একদিন এক ন্যাড়া দরবেশ সেই দোকানে গেলে তোতা পাখির জবান হাসতে হাসতে বলে ওঠে, ‘দরবেশ, তোমার মাথায় এ রকম টাক কেন? তুমিও কি আমার মতো তেলের বোতল ফেলে দিয়েছিলে?’

এই সাদামাটা গল্পে রুমি বলতে চেয়েছেন, আউলিয়ারা নিজেদের নবী-রাসুলদের তুলনা করলে অনেক বড় ভুল করবেন। শুধু মাথার টাক দেখেই তোতা পাখিটি দরবেশকে নিজের সঙ্গে তুলনা করেছিল। কিন্তু দুনিয়ায় অনেক কিছুই দেখতে এক রকম হলেও তাঁর প্রকৃতি ও স্বরূপ একেবারে আলাদা। সাধারণ ওলামারা অনেক সময় ওলি-আউলিয়াদের মর্যাদা বুঝতে অক্ষম হয়ে তাঁদের নিজেদের মতোই সাধারণ মানুষ মনে করে থাকে।

মাওলানা রুমি মানুষের উদ্দেশে বলেছেন, মোমবাতি হওয়া সহজ কাজ নয়। আলো দেওয়ার জন্য প্রথম নিজেকেই পুড়তে হয়। প্রিয় দর্শক শ্রোতা, জানি, এরকম ভিডিওর দর্শক বেশি নয়। তবুও আপনার মতো যারা দেখছেন, তাদের কমেন্টস পেলে মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি ও শামস তাবরিজিকে নিয়ে আরো কন্টেন্ট বানাতে পারি। শুভম।

তথ্যসূত্র: দৈনিক প্রথম আলো অনলাইন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top