বিপ্লব রায়।।
বিখ্যাত কথা সাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদ বলেছেন, মানুষকে কাঁদানো হয়তো সহজ। কিন্তু হাসানো খুবই কঠিন। কারণ, সব মানুষ সব সময় হাসার জন্য প্রস্তুত নয়।
তাহলে বুঝুন, মানুষ হাসানো কতটা কঠিন কাজ। অথচ একজন মানুষ জন্ম থেকে শত কষ্ট বুকে চেপেও মানুষ হাসানোর কাজটিই করে গেছেন আজীবন। হয়েছেন বিশ্ব বিখ্যাতও। তিনি হচ্ছেন বিশ্ব নন্দিত মূকাভিনেতা চার্লি চ্যাপলিন। তাঁর পুরো নাম ‘চার্লস স্পেনসার চ্যাপলিন’। কিন্তু অনেকে তাঁকে ‘শার্লট’, ’কার্লিটোস’, ‘দ্য লিটল ট্র্যাম্প বা ভবঘুরে’ নামেও ডাকেন।
চার্লি ভক্তরা বলেন, বিশ্বের ইতিহাসে সর্বকালের সেরা চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্বদের তালিকায় চার্লি চ্যাপলিনের নাম সবার উপরেই থাকবে নিঃসন্দেহে। ব্রিটিশ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের পাশাপাশি তিনি ছিলেন চিত্র পরিচালক ও সফল সুরকার। চলুন, এবার জেনে নেই সফল এই ব্যক্তির জন্ম ও তাঁর বেদনার ইতিহাস।
ধারণা করা হয়, চার্লি চ্যাপলিন জন্মেছিলেন ১৮৮৯ সালের ১৬ এপ্রিল। লন্ডনের ওয়ালউওর্থে। তবে অনেকে মনে করেন, তিনি জন্মেছিলেন ফ্রান্সে। আবার, ২০১১ সালে উদ্ধার হওয়া চ্যাপলিনের একটি চিঠি থেকে পাওয়া তথ্যমতে, ইংল্যান্ডের স্ট্যাফোর্ডশায়ারের একটি ক্যারাভ্যানে তিনি ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন। তাই তাঁকে ব্রিটিশ নাগরিক হিসেবেই মনে করেন অধিকাংশ মানুষ।
চার্লি চ্যাপলিনের বাবার নাম ‘চার্লস চ্যাপলিন সিনিয়র’। তার মায়ের নাম ‘হানাহ চ্যাপলিন’। তারা দু’জনেই মঞ্চে অভিনয় করতেন। গানও গাইতেন বেশ ভালোই। কিন্তু জন্মের পর থেকেই তিন বছরের কাছাকাছি বয়সে এসেই দেখতে হয় তাঁর বাবা-মায়ের আলাদা হয়ে যাওয়া। এরপরই যেন দুর্ভোগ নেমে আসে চার্লি চ্যাপলিনের জীবনে। তবে এই বিচ্ছেদের পর মায়ের কাছেই স্থান হয় চার্লি চ্যাপলিন ও তাঁর সৎ বড় ভাই সিডনি চ্যাপলিনের।
কিন্তু এভাবে কয়েক বছর যেতে না যেতেই চার্লি চ্যাপলিনের মা মানসিকভাবে গুরুতর অসুস্থ হন। তাকে ভর্তি করা হয় মানসিক রোগ নিরাময় কেন্দ্রে। এরপর অথৈ সাগরে পড়েন শিশু চ্যাপলিন। এরপর কোথায় যাবেন তিনি, কে দিবে তাঁর ভরণপোষণ !! পরে তাকে প্রথমে লন্ডনের একটি অনাথ আশ্রমে এবং পরে অসহায় ও দুঃস্থ শিশুদের জন্য তৈরি ‘সেন্ট্রাল লন্ডন ডিস্ট্রিক্ট স্কুল’-এ ভর্তি করা হয়। তার বয়স তখন মাত্র সাত বছর। এভাবে একদিকে চলে তাঁর বাঁচার লড়াই, আরেক দিকে মায়ের প্রতি আকুল টান। প্রায় দুই বছর এমনি করে ভবঘুরে জীবন কাটানোর পর খুব কম সময়ের জন্য হাসপাতালে মায়ের দেখা পান চার্লি চ্যাপলিন। কিন্তু তাঁর মা আর কখনোই পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠেননি। তাই কিছু দিনের জন্য অসহায় হয়ে মায়ের কাছ থেকে ফিরে যেতে হয় তার বাবার কাছে।
তিনি ছিলেন পুরোটাই মদ্যপ। তাই সেখানেও বেশি দিন ঠাঁই হয়নি হতভাগা চ্যাপলিনের। এভাবেই চরম অভাব-অনটন ও নিদারুণ কষ্টে কাটতে থাকে তাঁর শৈশব। তাই এক সময়ে উপায় না দেখে অভাবের তাড়নায় আট বছর বয়সে যুক্ত হন মঞ্চের অভিনয়ে। একটি যাত্রাদলের সাথে। দলের নাম ছিল ‘দ্য এইট ল্যাঙ্কাশায়ার ল্যাডস’। এ যেন ছিল চার্লি চ্যাপলিনের জীবনের আলোর রথে চড়া। আর ঘুরতে থাকে তাঁর জীবনের মোড়।
মনকাড়া অভিনয়ের জন্য একের পর এক পরিচালক ও প্রযোজকরা ভিড় করেন চ্যাপলিনের কাছে। চুক্তিবদ্ধ হন বিভিন্ন চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য। এরপর আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি এই গুণী মানুষটির। তবে আর্থিক দৈন্যতা কাটাতে তিনি অভিনয়ের পাশাপাশি অন্য কাজও খুঁজছিলেন চার্লি চ্যাপলিন। এভাবেই ১৯০৮ সালে আরো একটি নতুন সুযোগ জুটে যায় তাঁর ভাগ্যে। ১৮ বছর বয়সে হাস্য রসাত্মক নাটক তৈরির প্রতিষ্ঠান ‘দ্য কার্নো কোম্পানি’তে যোগদান করেন তিনি। ওই কোম্পানির হয়ে চার্লি চ্যাপলিন নিজেকে উপস্থাপন করেন আরো যোগ্য হিসেবে। এভাবেই বিভিন্ন স্থানে চলতে থাকে তাঁর দর্শক মাতানো পারফরমেন্স।
এরপর ১৯১০ সালে মঞ্চনাট্য প্রদর্শনীর জন্য তাকে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠায় ‘দ্য কার্নো কোম্পানি’। সেখানে প্রায় দুই বছর কাজ করে আবার ইংল্যান্ড ফিরে যান। তবে এর কয়েক মাস পর আবারও যুক্তরাষ্ট্রে যেতে হয় তাকে। আর সেখানেই আবারো ঘুরে যায় তার ভাগ্যরেখা।
যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক চলচ্চিত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠান চ্যাপলিনকে তাদের সাথে নিতে আমন্ত্রণ জানায়। কিন্তু অনেক ভাবনার পর ‘কিস্টোন স্টুডিও’তে কাজ করতে চুক্তিবদ্ধ হন চ্যাপলিন। এই স্টুডিওর অধীনেই ১৯১৪ সালে মুক্তি পায় তার প্রথম চলচ্চিত্র ‘মেকিং এ লিভিং’। যার মূল চরিত্রে অভিনয় করেছেন চ্যাপলিন।
তিনি বলতেন, আমি বিশ্বাস করি, যেদিন আমি কোনো কাজ করবো না, সেদিনের রাতের খাবারটা আমার প্রাপ্য নয়।
অসাধারণ প্রতিভাবান হওয়ায় বিভিন্ন কোম্পানিতে অভিনয় করে বিশ্বজুড়ে অনেক প্রশংসা কুড়িয়েছেন চ্যাপলিন।
অবশেষে চার্লি চ্যাপলিন ১৯১৯ সালে কয়েকজন অংশীদার নিয়ে গড়ে তুলেন ‘ইউনাইটেড আর্টিস্টস’ নামে চলচ্চিত্র-নির্মাতা প্রতিষ্ঠান। তার পরবর্তী কাজগুলো বিশ্বব্যাপী চার্লি চ্যাপলিনের জনপ্রিয়তা ব্যাপক শীর্ষে তুলেছিলো।
কিন্তু সুখপাখির সন্ধানে সারাজীবন চেষ্টা করেও তেমনটা দেখে মেলেনি চ্যাপলিনের।
চার্লি চ্যাপলিন ১৯১৮ সালে প্রথম বিয়ে করেন ‘মিল্ড্রেড হ্যারিস’ নামক এক মার্কিন অভিনেত্রীকে। তবে নানা নাটকীয়তা শেষে তাদের সংসার বেশি দিন টেকেনি। ১৯২১ সালে তাদের বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে।
ঠিক একই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে ১৯২৪ সালেও। ‘লিটা গ্রে’ নামে ১৬ বছরের এক নায়িকাকে বিয়ে করতে বাধ্য হন। কিন্তু সে বিয়েও ছিল ক্ষণস্থায়ী। এসব ঘটনা তাকে অনেক লজ্জাজনক পরিস্থিতির মুখে ফেলে চার্লি চ্যাপলিনকে।
এরপর তৃতীয় বিয়েটি ছিলো অভিনেত্রী পলেট গডার্ডের সাথে, ১৯৩৬ সালে। এ বিয়ে টিকেছিলো ৬ বছর। তবে সেই বিচ্ছেদটি তাদের দু’জনের সম্মতিতে। সর্বশেষ, ১৯৪৩ সালে চার্লি থিতু হন উওনা চ্যাপলিনের সাথে। আর এ সংসারটি টিকেছিলো জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। চার্লি উওনা সম্পর্কে বলেছেন, সেই তার একমাত্র আদর্শ জীবনসঙ্গিনী। যে সব সময় তার পাশে ছিল।
তিনি বলেছেন, তার মা’ই তার প্রেরণার একমাত্র উৎস। তাই আর্থিক স্বচ্ছলতা হওয়ার পর তিনি তার মাকে ব্রিটেন থেকে আমেরিকায় নিয়ে যান। সেখানে পরম মমতায় মায়ের সেবা করেছেন তিনি।
যুক্তরাষ্ট্র থেকে ইউরোপে চলে যাওয়ার পর সুইজারল্যান্ডে বসবাস শুরু করেন চার্লি চ্যাপলিন। আর সেখানেই ১৯৭৭ সালের বড়দিনে মহাপ্রয়াণ ঘটে খ্যাতিমান এই মানুষটির।