গৌরবের বিজয় দিবস আজ

বাণীবিতান ডেস্ক।।

১৬ই ডিসেম্বর, বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি অবিস্মরণীয় দিন। এই দিনটি কেবলমাত্র একটি তারিখ নয়, এটি একটি জাতির সংগ্রামের চূড়ান্ত বিজয়ের প্রতীক। ১৯৭১ সালের এই দিনে দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ শেষে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করে, এবং বাংলাদেশ বিশ্ব মানচিত্রে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। মহান বিজয় দিবস আমাদের জাতীয় অহংকার, গৌরব এবং মুক্তির চেতনার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

প্রতিবছর বিজয় দিবস উদযাপনের জন্য একটি প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়, যা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও সমসাময়িক প্রেক্ষাপটকে ধারণ করে। এটি আমাদের জাতীয় ঐক্যের প্রতি গুরুত্বারোপ করে এবং সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের জন্য সহযোগিতার মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করে।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জনগণ একটি অবিচল সংকল্প নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শোষণ, বৈষম্য, এবং দমনপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা ছিল অবশ্যম্ভাবী। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেও পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ক্ষমতা হস্তান্তরে অস্বীকৃতি জানায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে, ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনী বর্বর “অপারেশন সার্চলাইট” চালিয়ে নিরীহ মানুষের উপর হত্যাযজ্ঞ চালায়।

এরপরই শুরু হয় দীর্ঘ মুক্তিযুদ্ধ, যেখানে বাংলাদেশি জনগণ, মুজিবনগর সরকার, এবং মুক্তিবাহিনী একত্রে লড়াই করে। এই যুদ্ধে ভারতের সহযোগিতাও ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ১৬ই ডিসেম্বর সেই সংগ্রামের চূড়ান্ত সফলতার দিন, যখন পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পণ করে।

জাতীয় জীবনে ঐক্যের গুরুত্ব অপরিসীম। মুক্তিযুদ্ধের সময় গোটা জাতি জাতি-ধর্ম-বর্ণের উর্ধ্বে উঠে এক হয়ে লড়েছিল। বর্তমান প্রজন্মের জন্য এই ঐক্যের বার্তা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক, বিশেষ করে যখন সমাজ বিভাজনের নানা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি।

মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীনতা কেবল একটি ভূখণ্ডের স্বাধীনতা নয়; এটি ছিল একটি জাতির আত্মমর্যাদা, ভাষা, সংস্কৃতি এবং অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য লড়াই। বর্তমান প্রজন্মকে এই মহান অর্জনের মহিমা বুঝতে হবে এবং সেই চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে এগিয়ে যেতে হবে।

বর্তমান বিশ্বে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা, সামাজিক বিভাজন এবং বিভ্রান্তিমূলক প্রচারণা আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। এবারের বিজয় দিবসের প্রতিপাদ্য আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, একতা এবং সম্প্রীতি ছাড়া কোনো জাতি টেকসই উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি অর্জন করতে পারে না।

যে চেতনা মুক্তিযুদ্ধের মর্মবাণী ছিল, তা হলো বৈষম্যহীন সমাজ গঠন। দারিদ্র্য, শিক্ষা, এবং নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে আমরা অনেকদূর এগিয়েছি, তবে এই প্রক্রিয়ায় আরও অনেক কাজ বাকি।

মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ এবং বিজয়ের চেতনা তরুণ প্রজন্মের মধ্যে নতুন উদ্যম তৈরি করতে পারে। এটি শুধু ইতিহাস নয়, বর্তমানের সমস্যা মোকাবিলার অনুপ্রেরণাও হতে পারে।

বিজয় দিবস উদযাপনের সময় শুধু আনন্দ নয়, এটি আমাদের জাতীয় দায়বদ্ধতার প্রতিফলন। পতাকা উত্তোলন, পুষ্পার্ঘ অর্পণ, এবং কুচকাওয়াজের মাধ্যমে বীর শহীদদের স্মরণ করার পাশাপাশি আমাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাগুলোকেও চিহ্নিত করতে হবে।

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি এবং ইতিহাস সংরক্ষণে নতুন প্রজন্মকে সম্পৃক্ত করা অত্যন্ত জরুরি। স্মৃতিসৌধ, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, এবং মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সাহিত্য ও চলচ্চিত্রের প্রচার-প্রসার বাড়াতে হবে।

বিজয় দিবসের প্রতিপাদ্যের সাথে সামঞ্জস্য রেখে, তরুণ প্রজন্মকে প্রযুক্তি, শিক্ষা, এবং সাংস্কৃতিক অঙ্গনে নেতৃত্ব প্রদান করতে হবে। তারা দেশের উন্নয়ন এবং সুশাসনের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

১৬ই ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবস কেবলমাত্র একটি স্মৃতির দিন নয়; এটি আমাদের জাতীয় আদর্শ এবং স্বপ্ন পূরণের অঙ্গীকারের দিন। এবারের প্রতিপাদ্য “একতার মহানবাণ, মুক্তি বাংলার মহিমান” আমাদের জন্য নতুন করে অঙ্গীকার করার আহ্বান জানায় যে, আমরা ঐক্যবদ্ধ থেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করে একটি সমৃদ্ধ, শান্তিপূর্ণ, এবং সম্মানজনক বাংলাদেশ গড়ে তুলব।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top