গহীন অরণ্যে প্রেমের গল্প

বিজয়া দাস।।

তৃষা আর অনিরুদ্ধ—দুই জগতের মানুষ। তৃষা ছিল শহুরে উচ্চশিক্ষিত ও জীবনমুখী। অন্যদিকে অনিরুদ্ধ ছিল নিভৃত এক গ্রামের সন্তান, প্রকৃতিকে ভালোবাসত। তাদের প্রথম দেখা হয় এক গ্রীষ্মের ভ্রমণে। তৃষা বন্ধুবান্ধব নিয়ে গ্রামে বেড়াতে গিয়েছিল, আর অনিরুদ্ধ সেখানে স্থানীয় গাইড হিসেবে কাজ করত।

অরণ্যের নির্জনতায় হাঁটতে হাঁটতে তৃষার চোখে ধরা পড়ে অনিরুদ্ধের নিষ্পাপ হাসি আর প্রকৃতির প্রতি গভীর টান। অন্যদিকে, অনিরুদ্ধের কাছে তৃষা যেন এক আধুনিক পৃথিবীর প্রতীক। যার সঙ্গে সে আগে কখনও পরিচিত হয়নি। সেই প্রথম দেখা ছিল যেন প্রকৃতির সঙ্গে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা।

প্রথম দেখাতেই তাদের মধ্যে এক অদ্ভুত ভালো লাগা শুরু হয়। কিন্তু এর প্রকাশ করেনি কেউ। তবে দুজন দুজনকে মনে মনে যেন গ্রহণ করে নিয়েছে। তাই তৃষা প্রায় প্রতিদিনই অনিরুদ্ধের সঙ্গে ঘুরতে যেত প্রকৃতির সৌন্দর্য অবলোকনের জন্য। কখনো নদীর ধারে বসে কথা বলা, কখনো পাহাড় চূড়ায় ওঠার চ্যালেঞ্জ। এই পথ চলাতেই গড়ে ওঠে এক গভীর, অমলিন বন্ধুত্ব।

অনিরুদ্ধ তাকে অরণ্যের অজানা গল্প শোনাতো—গাছের কথা, পাখির গান আর ছোট্ট গ্রামের মানুষদের জীবন। তৃষা এসব শুনে মুগ্ধ হতো। তার মনে হতো, এই ছেলেটির মতো সরল আর কেউ নেই। আর অনিরুদ্ধ অনুভব করত, তৃষার উপস্থিতি তার জীবনের নিঃসঙ্গতা দূর করে এক অদ্ভুত প্রশান্তি এনে দেয়।

একদিন সূর্যাস্তের সময় তারা অরণ্যের এক নির্জন কোণায় বসে ছিল। পাখির কলতান, হালকা বাতাস আর রঙিন আকাশের মাঝে অনিরুদ্ধ হঠাৎ বলল, “তোমাকে যেন অনেক দিন ধরে চিনি। তৃষা, তুমি ফিরে গেলে কি আমি এই অরণ্যে একা হয়ে যাব?”

তৃষা কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর আস্তে করে বলল, “আমি কি আসলেই ফিরে যাব?” এই কথার মধ্য দিয়েই তাদের মধ্যে জন্ম নেয় এক গভীর প্রেম। সেই প্রেম ছিল নিঃশব্দ অথচ গভীর, যেন ঝর্ণার নীরব অথচ অবিরাম প্রবাহ।

তাদের সম্পর্ক সহজ ছিল না। তৃষার পরিবার চাইত সে বিদেশে পড়াশোনা করে বড় পদে চাকরি করবে। অন্যদিকে, অনিরুদ্ধ ছিল সাধারণ পরিবারের। যার জীবনের গণ্ডি তার গ্রাম আর অরণ্যেই সীমাবদ্ধ।

তৃষার বাবা-মা এই সম্পর্ক মানতে নারাজ। তারা ভাবতেন, এই প্রেম কোনো ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে পারবে না। এক পর্যায়ে তৃষাকে তার বাব-মা শহরে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। অনিরুদ্ধের জীবনে নেমে আসে গভীর অন্ধকার। সেই অন্ধকার যেন এক দীর্ঘ রাত্রি, যেখানে শুধুই অপেক্ষা আর একাকিত্ব।

তৃষার শহরে ফেরার পর সময়ের স্রোতে তাদের মধ্যে দূরত্ব বাড়তে থাকে। চিঠির মধ্যে যতই অনুভূতি লেখা থাকুক, বাস্তবতার কঠিন রূপরেখা তাদের ক্রমেই আলাদা করে দেয়। তৃষা বুঝতে পারে, তার আধুনিক জীবনের চাহিদা আর অনিরুদ্ধের অরণ্যমুখী জীবনযাপন একই স্রোতে মিশতে পারবে না।

অনিরুদ্ধও একদিন তৃষাকে একটি চিঠি লিখল: “তোমার পথ শহরের আলোয় আলোকিত হোক। আমি থাকব অরণ্যের ছায়ায়। আমরা একে অপরকে ভালোবাসি, কিন্তু সেই ভালোবাসা আমাদের জীবন নয়—সেটি দুই ভিন্ন পথের যাত্রী।”

তৃষা সেই চিঠি পড়ে দীর্ঘক্ষণ কাঁদল। কিন্তু একসময়ে বুঝতে পারল, ভালোবাসা সব সময় একসঙ্গে থাকার নাম নয়, এটি একে অপরকে মুক্তি দেওয়ার নামও।

তৃষা আর অনিরুদ্ধ তাদের নিজ নিজ পথে এগিয়ে যায়। অনিরুদ্ধ অরণ্যের প্রকৃতিকে রক্ষার কাজে নিজেকে নিবেদন করে। তৃষা নিজের শহরে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করে, যা পরিবেশ রক্ষা নিয়ে কাজ করে। তাদের ভালোবাসা রয়ে যায় স্মৃতির গভীরে, ঠিক যেন রবীন্দ্রনাথের কবিতার মতো:

“যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে
তবে একলা চলো রে।”

তাদের গল্প প্রমাণ করে, ভালোবাসা মানে কেবল একত্রে থাকা নয়; এটি একে অপরের জীবনের পরিপূর্ণতার জন্য আলাদা পথে চলাও হতে পারে। তাদের প্রেম আজও অরণ্যের বাতাসে আর শহরের গুঞ্জনে মিশে আছে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top