
বিপ্লব রায়।।
‘‘ আমি কোথায় পাব তারে, আমার মনের মানুষ যে রে- এই গানটি গুণগুণ করে কন্ঠে তোলেননি, সংগীত পিপাসু এরকম মানুষ মনে হয় খুব বেশি নেই। অথচ এই গানটির রচয়িতা যে গগন হরকরা, তা হয়তো জানা নেই সবার। অথচ গগন হরকরার এই গানের সুরেই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সুর দিয়েছেন আমাদের জাতীয় সংগীতের। আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি। আহ! কী অমৃত সুধা!
অথচ গগন হরকরা ছিলেন নিভৃতচারী একজন সংগীত স্রষ্টা। যাঁর সঙ্গে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরিচয়ের পরই সাদরে গ্রহণ করেছিলেন। বলেছিলেন, গগন হরকরা এক বিস্ময়কর প্রতিভা।
এই লোকশিল্পীর আসল নাম গগন চন্দ্র দাম। কিন্তু গগন হরকরা নামেই সবার কাছে পরিচিত ছিলেন তিনি। কুষ্টিয়ার শিলাইদহ ডাকঘরে চিঠি বিলির কাজ করতেন গগন হরকরা। কিন্তু সংগীতের প্রতি তাঁর ছিল গভীর আগ্রহ। তাই গানের জগতেই সর্বদা ডুবে থাকতেন তিনি।
গগন হরকরার জন্ম সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায়নি। তবে ধারণা করা হয়, ১৮৪০ সালে কুষ্টিয়ার এক প্রত্যন্ত গ্রামে জন্মেছিলেন এই বাউল সাধক। গগন হরকরা হেঁটে হেঁটে দায়িত্ব পালনের সময়ও গান করতেন বলে ধারণা করা হয়। তাঁর গানের কন্ঠ ছিল সুমধুর। গগন হরকরার গান শুনে মুগ্ধ হয়ে শুনতেন শ্রোতারা।
মূলত: লালন ফকিরের ভাব অনুসারী ছিলেন গগন হরকরা। তাঁর গানের মধ্যে ছিল প্রকৃতির রূপ, রস আর গ্রামের মেঠো মানুষের সারল্য, আবেগ ও ভালোবাসার গল্প। হৃদয়ে ধারণ করতেন বাউলের চিন্তা ও কর্ম।
লালনের সান্নিধ্য খুব পছন্দ করতেন গগন। তাই অবসর পেলেই ছুটে তিনি যেতেন লালনের আখড়ায়। মজে যেতেন লালন সাঁইজীর আধ্যাত্মিক সাধনায়।
গগন হরকরাকে পছন্দ করতেন লালন সাঁইজীও। ভক্ত না হয়ে উপায় কী? গগনের মধ্যে ছিল ঐশ্বরিক এক শক্তি। তাইতো তাঁর মধ্যে ছিল এক অন্যরকম ঈশ্বর দর্শন। আর এর মাধ্যমে গান লিখতেন আর নিজের কণ্ঠে তুলে ছড়িয়ে দিতেন সবার মধ্যে।
গগনের গানের একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও। তিনি গগনের কাছে গগনের নিজের গান ও লালনের গান শুনতে চাইতেন।
যেভাবে গগন হরকরার সঙ্গে কবি গুরুর পরিচয় হলো:
১৮৮৯ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন পারিবারিক জমিদারি দেখাশোনা করতে বাংলাদেশের শিলাইদহ ও শাহজাদপুরে নিয়মিত যাতায়াত করতেন। এই সময় তিনি বাউল গানের প্রতি আকৃষ্ট হন। এই যাতায়াতের সময় প্রায়ই শিলাইদহে এসে থাকতেন রবীন্দ্রনাথ। তখন লালন, গোসাঁই গোপাল, ফিকিরচাঁদ, সর্বক্ষেপী বোষ্টমী এবং গোসাঁই রামলালের মতো অসংখ্য বাউলের সঙ্গে কবি গুরুর পরিচয় ঘটে। বাউল-ফকিরদের গান কবিকে অন্য এক সুরের ভুবনে নিয়ে যেতো। এসব বাউল-ফকিরদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সবচেয়ে প্রিয় ছিলেন গগন হরকরা। কারণ, গগনের গভীর চিন্তা ও গানের সঙ্গে যেন অদ্ভুতভাবে রবীন্দ্রনাথের মিলে যায়।
একদিন বজরার ছাদে বসে পদ্মার শোভা উপভোগ করছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এমন সময় ডাক বিভাগের এক পিয়ন চিঠির থলে পিঠে নিয়ে আপন মনে গান করতে করতে সে পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন। সেই সুর ও কথা কবির কর্ণে প্রবেশ করে। এই সুর যেন রবীন্দ্রনাথকে অন্য এক জগতের দিশার কথা মনে করিয়ে দেয়। গগন হরকরার এই গান শুনে মুগ্ধ হন কবি। এরপর তাঁকে ডেকে পাঠালেন তিনি। গাঁয়ের লোক তাকে চেনে ডাকে গগন হরকরা নামে। কিন্তু তিনি যখন কবির কাছে নিজের পরিচয় দিলেন, তখন বললেন, তার নাম গগনচন্দ্র দাম। গ্রামের সাধারণ এক মানুষ, নিজের রচিত গানে নিজেই সুর দেন।
এরপর থেকেই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে গগনের এক আত্মার মিলন ঘটে। রবীন্দ্রনাথ যখন শিলাইদহে যেতেন, তখন স্বাভাবিকভাবেই ডাক পড়তো গগনের। সন্ধ্যার পর নির্জনে বজরার ছাদে বসে কিংবা শিলাইদহের কুঠিবাড়িতে আয়োজিত কোনো গানের জলসায় গগনের গান ছিল বাঁধা। কবি তার বন্ধুবান্ধব ও গুণীজনের মাঝে গগনের গান শোনানোর জন্য উৎসুক থাকতেন।
একদিন শিলাইদহের কুঠিবাড়িতে এক জমজমাট আড্ডার আসরে অতিথি হয়ে এসেছেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট দ্বিজেন্দ্রলাল রায়। যিনি ডিএল রায় নামে পরিচিত। সাহিত্যিক ও গীতিকার হিসেবে তখন চারদিকে তার বেশ সুনাম। হাসির ছড়া, নাটক আর গানে তার দক্ষতা সকলকে মুগ্ধ করে। তিনি রবীন্দ্রনাথের বিশেষ বন্ধু। তার তদারকিতে ব্যস্ত বাড়ির সব মানুষ। খাওয়াদাওয়ার পর শুরু হলো গানবাজনা। দিজেন্দ্রলাল রায়কে গান গাইতে দু’বার অনুরোধ করতে হয় না। আসরে হারমোনিয়াম বাজিয়ে তিনি বেশ কয়েকটি গান পরিবেশন করলেন। সকলেই সে গান শুনে তাঁর প্রশংসায় পঞ্চমুখ।
কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তো একটু গম্ভীর স্বভাবের। তিনি ওই আসরে একটু পালানোর কথা ভাবছিলেন। কারণ সেদিন সকাল থেকেই তাঁর গলায় একটু একটু ব্যথা। তাঁকে এবার গান গাইতে বললে তিনি বন্ধুবরকে বললেন, আমার গান তো অনেক শুনেছেন। আজ এক নতুন শিল্পীর গান শুনুন। আসরের এক কোণায় ফরাসের ওপর সঙ্কুচিত হয়ে বসে থাকা রোগা-হ্যাংলা এক ব্যক্তির দিকে কবিগুরু নির্দেশ করতেই মানুষটি আরও কাঁচুমাচু হয়ে উঠলেন। গগন বাবু চমকিত হয়ে বললেন, “রাজাবাবু, সত্যিই কী আমাকে ডাকছেন?”
এ আসরের বড় বড় মানুষদের মধ্যে আমাকে গান করতে হবে! এলাকায় সবাই তাকে এক নামে চেনে। রবীন্দ্রনাথ তার বন্ধুকে এর পরিচয় করিয়ে দিলেন। “লালনের গান তো শুনেছেন। এবার গগনের গান শুনুন।” গগন শ্রোতাদের সকলকে নমস্কার জানিয়ে শুরু করলেন তার গান:
“লাগি সেই হৃদয়শশী সদা প্রাণ হয় উদাসী
পেলে মন হতো খুশি দেখতাম নয়ন ভরে।
আমি প্রেমানলে মরছি জ্বলে নিভাই অনল কেমন করে
মরি হায় হায় রে
ও তার বিচ্ছেদে প্রাণ কেমন করে
ওরে দেখ না তোরা হৃদয় চিরে। …..”
গগনের এই উদাত্ত কণ্ঠের গান শেষ হলে অনেকক্ষণ কারো মুখ দিয়ে কোনো কথাই বেরোলো না।
শিলাইদহে এসে রবীন্দ্রনাথ প্রথমে লালন শাহ এবং পরে গগনের বাউল প্রেমে বেশ প্রভাবিত হয়েছিলেন। কবির মনে ধর্ম নিয়ে যে নতুন চিন্তাভাবনার উদ্ভব হয়েছিল, তারই স্বীকৃতি খুঁজে পেলেন তিনি বাউল সঙ্গীতে। বারবার তার গানে প্রকাশ পেতো লাগলো বাউলের নানা সুর।
“দেখেছি রূপসাগরে মনের মানুষ কাঁচা সোনা।
তারে ধরি ধরি মনে করি ধরতে গেলে ধরা দেয় না।
সে মানুষ চেয়ে চেয়ে ঘুরিতেছি পাগল হয়ে,
মরমে জ্বলছে আগুন আর নিভে না,
এখন বলে বলুক লোকে মন্দ, বিরহে তার প্রাণ বাঁচে না। ”
গগন হরকরা সম্পর্কে আরো জানতে এই লিংকে ক্লিক করে বই সংগ্রহ করতে পারেন। বইটি সংগ্রহে রাখার মতো।