সোনালী চুল, চোখের মণির রঙ নীল। বলছি পাকিস্তানে বসবাস করা শ্বেতাঙ্গ এক জনগোষ্ঠীর কথা। যারা শত শত বছর ধরে কালাশ জাতি হিসেবে পরিচিত। দেশটির চিত্রাল জেলায় এই জনগোষ্ঠীর বাস। শেতাঙ্গ কালাশ জনগোষ্ঠীর মেয়েদের দেখতে অনিন্দ্য সুন্দর। পাকিস্তানের অন্য কোনও গোষ্ঠীর মানুষদের সঙ্গে তাঁদেও চেহারা, ধর্ম, সংস্কৃতি, সমাজব্যবস্থা ও খাদ্যাভাসের মিল নেই। এ জাতির নাম হচ্ছে- কালাশ।
হিন্দুকুশের পাহাড়ি ঢালে কয়েকশো বছর ধরে বংশ পরম্পরায় বসবাস করে আসছে এই কালাশ জাতিগোষ্ঠী। তাদের বাড়িঘরের অবস্থা অতি সাধারণ। এসব সর্বদা প্রচন্ড স্বাধীনচেতা ও লড়াকু জাতি। ইচ্ছে হলে নিজেরাই ঘরে সুরা বানিয়ে পান করেন। পাকিস্তানে বসবাস করলেও তারা মুসলিম নয়। কালাশরা নানা দেবদেবীর পুজো করেন। এ গোষ্ঠীর মেয়েরা অনেক স্বাধীনচেতা। বিয়ের ক্ষেত্রে নিজেরাই নিজেদের স্বামী বেছে নিতে পারেন। এটাও তাদের শত শত বছরের ঐতিহ্য।
নাচ, গান, আমোদ-প্রমোদে ভরপুর তাঁদের জীবন। শীতের সময় কালাশ নারী-পুরুষরা একসঙ্গে বল নিয়ে বরফের উপর চিকিক গাল নামে একটি খেলা খেলেন। তবে এই ধরনের জীবনযাত্রা পাকিস্তানে বড় মাত্রার অপরাধ। এরা দার্দীয় আদিবাসী জনগোষ্ঠী।
পাকিস্তানের চিত্রাল জেলার প্রত্যন্ত পাহাড়ি বুম্বুরেট, রুম্বুর ও বিরির উপত্যকায় বসবাস করেন কালাশরা। এরা এতই শক্তিশালী যে, পাকিস্তান থেকে শিখ, হিন্দু ও খ্রিষ্টানদের একের পর এক বের করে দেওয়া হলেও কালাশদের ক্ষেত্রে তা সম্ভব হয়নি। তাঁরা লড়াই করে নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রেখেছেন সেখানে। কালাশ গোষ্ঠীর সদস্য সংখ্যাও খুব বেশি নয়। মাত্র ১৪ থেকে ১৫ হাজার। তবুও তারা পাকিস্তান সরকারের শাসন মানেন না। নিজেরাই নিজেদের আইনে চলেন।
কারণ কালাশ জনগোষ্ঠীর সদস্যরা মনে করেন, এই উপজাতিরা গ্রিক বীর আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের সৈন্যসামন্তের বংশধর। তাঁরা বংশ পরম্পরায় সমর বিদ্যায় পারদর্শী। ছোটবেলা থেকেই তাদেরকে সমর বিদ্যার কৌশল শেখান গুরুজনরা। তাই তারা পরাধীনতায় বিশ্বাস করেন না।
ইতিহাসবিদদের মতে, প্রায় দুই হাজার বছর আগে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট উত্তর পাকিস্তানের পাহাড়ি এলাকা জয় করেছিলেন।
কালাশরা এখন যেখানে বসবাস করেন, আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট সেই উত্তর পাকিস্তানের পাহাড়ি এলাকা জয় করেছিলেন। কালাশ জনগোষ্ঠীর বাসিন্দারাও সেখানে বাস করছেন প্রায় দু’হাজার বছর ধরেই। তারা কথাও বলেন নিজেদের সৃষ্ট কালাশা ভাষায়। পাকিস্তানের ক্ষুদ্রতম জাতিগত গোষ্ঠী হিসেবে বিবেচিত তারা।
কালাশরা ঐতিহ্যগতভাবে প্রাচীন হিন্দুধর্মের একটি রূপকে ধর্ম হিসেবে অনুসরণ করেন। তবে অনেকে রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধার আশায় স্বধর্ম ছেড়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন। পরে তাদেরকে কালাশ সম্প্রদায় থেকে বাদ দেয়া হয়।
কালাশ আদিবাসীরা আদি সনাতন ধর্মের একটি সম্প্রদায়কে অনুসরণ করে। কালাশের একজন নেতা সাইফুল্লাহ জান জানিয়েছেন “কালাশ গোষ্ঠীর কেউ ধর্মান্তরিত হলে তারা আর আমাদের মধ্যে রাখা হয় না। তারা এই গ্রামেই থাকতে পারেন না।
কালাশ নারীদের ক্ষেত্রে আরেকটি বিশেষ পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। তারা ঋতুবতী হলে ওই নির্দিষ্ট সময় কাটানোর জন্য রাখা হয় ঋতুস্রাব ভবনে। যার নাম “বশালেনী”। “শুদ্ধতা” ফিরে না পাওয়া পর্যন্ত তাদের বশলেনীতে থাকতে হয়। সন্তান প্রসব করতে হয়।
১৪-১৫ বছর বয়সেই বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয় কালাশ নারীদের। এই বয়সে কালাশ মেয়েরা প্রেমিকের সাথে পালিয়ে বিয়ে করলেও তাদের ক্ষেত্রে সামাজিক কোনো নিষেধ নেই। শুধু তাই নয়, ইচ্ছে করলে বিবাহিত নারীরাও পুরাতন স্বামী ফেলে নতুন কোনো পুরুষকেও গ্রহণ করতে পারেন। এ ক্ষেত্রে একটি শর্ত রয়েছে। নতুন স্বামীর সঙ্গে পালাতে হলে পুরাতন স্বামীকে চিঠি লিখে জানাতে হবে। রেখে যেতে হয় কিছু আর্থিক অনুদানও। বিষয়টি যদিও আমাদের মতো দেশের ক্ষেত্রে খুবই বেদনার। কিন্তু কালাশদের প্রথাই এটা।
কালাশ অধ্যুসিত এলাকার জমি খুব উর্বর। তারা উর্বর জমিতে গম, ভুট্টা, আঙুর, আপেল, আখরোট ও খুবানিসহ নানা জাতের শস্য চাষ করেন। এসব সেখানে এতবেশি ফলে যে, তারা নিজেদের খাবারের জন্য রেখে বহু টাকায় বিক্রিও করেন।
কালাশ জনগোষ্ঠীর কেউ মারা গেলে তারা শোক পালন করেন না। বরং মৃত্যুকে তারা জীবনপ্রবাহের সমাপ্তি হিসেবে গণ্য করে। এসময় তারা নাচ, গান ও ভোজ উৎসবের মধ্য দিয়ে মৃত্যুকে উদযাপিত করেন।
তথ্য- উইকি পিডিয়া অনুবাদ এবং ওয়েবসাইট
ছবির কৃতজ্ঞতা: গুগল