
বিপ্লব রায়।।
এই ত মানব-জীবন ভাই!
এই আছে আর, এই নাই।
যেমন পদ্মপত্রে, জল ঢালে সদাই;
তেম্নি দেখিতে দেখিতে নাই।
আজ গেল আমার
পরে যাবে কেহ;
অনিত্য এই মানবদেহ!
তবে কেন অহঙ্কারে
বল মত্ত সদাই ॥
কাঙাল হরিনাথ মজুমদার। যিনি সবার কাছে কাঙাল হরিনাথ নামেই পরিচিত। যাঁর নাম শুনেই সহজে বোঝা যায়, কতটা বিনয়ী ও মানবিক ছিলেন তিনি। যে কারণে নিজের নামের সঙ্গেই নিজে যুক্ত করেছিলেন কাঙাল উপাধি। কী কারণে তাঁকে কাঙাল বলে ডাকা হয়, তাও বলা হয়েছে এই লেখায়।
কাঙাল হরিনাথ একাধারে ছিলেন সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও বাউল গান রচয়িতা। তাঁর প্রকৃত নাম হরিনাথ মজুমদার। কিন্তু সবার কাছে পরিচিত ছিলেন কাঙ্গাল হরিনাথ নামেই। অনেকে কাঙাল ফিকিরচাঁদ বা ফিকিরচাঁদ বাউল নামেও ডাকতেন তাঁকে। একজন উদার ও চিন্তাশীল মানুষ ছিলেন কাঙাল হরিনাথ। ভাবতেন সমাজ সংস্কার ও মানুষের জীবনের উন্নয়নে কাজ করার।
১৮৩৩ সালে কাঙাল হরিনাথ মজুমদার জন্মেছিলেন নদীয়া (বর্তমান কুষ্টিয়া) জেলার কুমারখালি গ্রামে। পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা তেমন ভালো ছিল না। তবে ছেলেবেলায় স্থানীয় একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়াশোনা শুরু করেছিলেন তিনি। পরে অর্থনৈতিক সংকটের শিকার হয়ে সেই বিদ্যা আর বেশি দিন অর্জন করা হয়নি হরিনাথের। আর এই বিষয়টি হৃদয়ে বেশ ক্ষত সৃষ্টি হয় তাঁর মধ্যে। তবে থেমে যাননি হরিনাথ। তিনি বলতেন, যেখানে থামবে, সেখান থেকে আবার শুরু করো। এসব বলে সবার মধ্যে স্বপ্ন জাগাতেন কাঙালি হরিনাথ।
যেমন ভাবনা, কাজও ঠিক সেভাবেই করতেন তিনি। নিজের পড়াশোনা না হলেও গ্রামের সবার মধ্যে শিক্ষার প্রসারের জন্য বন্ধুদের সহায়তায় ১৮৫৫ সালে নিজ গ্রামে একটি ভার্নাকুলার স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন কাঙাল হরিনাথ। সেখানেই বেতন বিহীন শিক্ষকতায় মনোনিবেশ করেন তিনি। আর এভাবেই তাঁর প্রাণপন চেষ্টায় গোটা এলাকায় সম্প্রসারিত হয় শিক্ষা। এরপর বছর তাঁরই প্রচেষ্টায় কুষ্টিয়ার কুমারখালিতে একটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন কৃষ্ণনাথ মজুমদার অর্থাৎ কাঙাল হরিনাথ। গ্রামের সাধারণ মানুষের উন্নতির জন্য এবং তাদের শোষণ-পীড়নের বিরুদ্ধে সারা জীবন আন্দোলন করেছেন হরিনাথ।
এক পর্যােয়ে অত্যাচারিত এবং অসহায় কৃষক সম্প্রদায়কে রক্ষার জন্য তিনি শুরু করেন সাংবাদিকতা। প্রথমে সংবাদ প্রভাকর পত্রিকায় সাংবাদিকতা শুরু করেন হরিনাথ। পরে ১৮৬৩ সালে নিজেই ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’ নামে একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করেন তিনি। পত্রিকাটি পরে পাক্ষিক ও শেষে সাপ্তাহিকে উন্নীত করা হয়। তখন পত্রিকাটি বিক্রি হতো মাত্র ১ পয়সায়। তাঁর পত্রিকায় ছাপা হতো সাহিত্য, দর্শন ও বিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধ। পাশাপাশি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশ করা হতো তৎকালীন কৃষকদের প্রতি তখনকার নীলকর ও জমিদারদের শোষণ-অত্যাচারের খবর। এজন্যই কাঙাল হরিনাথকে বলা হয় মফস্বল সাংবাদিকতার পথিকৃত।
ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে পত্রিকায় লেখার কারণে তখনই হুমকির মুখে পড়তে হয়েছিল কাঙাল হরিনাথকে। ব্রিটিশরা স্থানীয় জমিদারদের দিয়ে তাঁকে তখন এসব না লিখতে ভয় দেখাতেন। বলতেন- ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে এভাবে লিখলে পরিণতি ভালো হবে না। কিন্তু কে শোনে কার কথা? হুমকিতে দমে যাননি কাঙাল হরিনাথ। ব্রিটিশ ও জমিদারদের অন্যায়-অত্যাচারের কথা একের পর এক লিখেই যেতেন তাঁর পত্রিকায়। এতে স্থানীয় মানুষের মধ্যে খুব প্রশংসায় ভাসতে থাকেন কাঙালি হরিনাথ। পাশাপাশি তাঁর গ্রাম বার্ত্তা পত্রিকাাটি বাঙালি সমাজে বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তবে তাতে তাঁর পরিবারের আর্থিক অবস্থা কখনো ভালো হয়নি। কারণ ওই এক পয়সায় পত্রিকা বিক্রি হলেও তার পুরোটাই প্রায় খরচ হয়ে যেত। কিন্তু তা সত্ত্বেও পত্রিকা প্রকাশের সুবিধার্থে ১৮৭৩ সালে তিনি একটি ছাপাখানা স্থাপন করেন। রাজশাহীর রাণী স্বর্ণকুমারী দেবীর সহায়তায় এভাবে দীর্ঘ ১৮ বছর পত্রিকা প্রকাশ অব্যাহত থাকে। পরে আর্থিক কারণে এবং সরকার মুদ্রণ শাসন ব্যবস্থার কারণে পত্রিকাটির প্রকাশনা বন্ধ করে দিতে হয়।

ব্যক্তিগত জীবনে হরিনাথ ছিলেন ফকির লালন শাহের শিষ্য। গাইতেন বাউল গান। তিনি আধ্যাত্মবাদ প্রচারের জন্য ১৮৮০ সালে ‘কাঙ্গাল ফিকির চাঁদের দল’ নামে একটি বাউল দল গঠন করেন। বাউল গানের ক্ষেত্রে হরিনাথের অবদান বিশেষভাবে স্মরণীয়। তিনি বহু সংখ্যক বাউল গান রচনা করেন এবং সেগুলি খুবই জনপ্রিয়তা অর্জন করে। তিনি সহজ ভাষায় ও সহজ সুরে গভীর ভাবোদ্দীপক রচনা করতেন এবং সেগুলি তাঁর দল নিয়ে গেয়ে বেড়াতেন।
গানের মধ্যে নিজেকে ‘কাঙ্গাল’ বলে বেশি পরিচিত করতে চেয়েছেন হরিনাথ। কারণ এই কাঙাল হচ্ছে নিজেকে ঈশ্বরের কাছে সমর্পণ। তাই বলে এক সময় কাঙ্গাল শব্দটি তাঁর নামের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়। তিনি লিখেছেন, ‘হরি দিন তো গেল সন্ধ্যা হলো পার করো আমারে’ তার একটি বিখ্যাত গান। ১২৯০-১৩০০ বঙ্গাব্দের মধ্যে তিনি কাঙ্গাল ফিকিরচাঁদ ফকিরের গীতাবলি নামে ১৬ খণ্ডে বাউল সংগীত প্রকাশ করেন। হরিনাথ শুধু গানেই নয়, গদ্য ও পদ্য রচনায়ও সমান পারদর্শী ছিলেন।
কাঙাল হরিনাথের জীবনকর্ম সম্বন্ধে জানতেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও। হরিনাথের লেখা দুই হাজার পৃষ্ঠার দিনলিপিও তিনি পড়েছেন। ফকির লালন শাহ’র প্রায় ২১টি লালনগীতি বই আকারে প্রকাশিত হয় কাঙাল হরিনাথের এই ‘এমএন’ প্রেস থেকেই। কাঙাল হরিনাথের বিরামহীন কর্মযজ্ঞের স্মৃতি আজও বহন করে চলেছে কুষ্টিয়ার কুমারখালী। কারণ, কাঙাল হরিনাথ বাঙালির গর্ব। তিনি যে আলো জ্বেলে দিয়ে গেছেন, সেই আলো জনম জনম ধরে মানুষের হৃদয়ে জ্বলবে।