-শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়।।
ফুলের গন্ধে ফোটার জন্যে
নারীর স্পর্শ পাবার জন্যে
ঘুমের মধ্যে কাঁদতে কাঁদতে
আমরা যেদিন যুবক হলাম।
বাইরে তখন বৃক্ষে বৃক্ষে
জলে স্থলে অন্তরীক্ষে
আমাদের সেই কান্না নিয়ে
গান গাইছে বড়ে গোলাম।’
সঙ্গীতের দেবতা ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলি খান (Bade Ghulam Ali) সাহেব-কে নিয়ে এই কবিতা উপহার দিয়েছিলেন বিখ্যাত কবি পূর্ণেন্দু পত্রী।
সঙ্গীতের দেবতা হয়েও ওস্তাদজি কখনও নিজেকে উচ্চশিক্ষিত গায়ক হিসেবে দাবি করতেন না। তিনি বলতেন, সংগীত হচ্ছে খেলা, নাচ কিংবা ঢেউয়ের মতো। তাঁর এই মনোভাব থেকে বোঝা যায় তিনি সংগীতকে গাম্ভীর্য থেকে কাঠিন্য থেকে মুক্ত করতে চেয়েছেন। সঙ্গীত জগতের দিকপালরা একবাক্যে চিরকাল বড়ে গোলাম আলি খান সাহেবকে গুরুর আসনেই বসিয়ে এসেছেন। কারণ, সূর্য তো একটিই হয় পৃথিবীতে।
পাকিস্তান থেকে চলে এলেন পশ্চিম বাংলায়
বড়ে গোলাম আলি খান ১৯০২ সালের ২ এপ্রিল তৎকালীন পশ্চিম পঞ্জাবের লাহোরের কাছে ছোট্ট শহর কাসুরের এক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। কাসুর বর্তমানে পাকিস্তানের অংশ। তাঁর পরিবার ছিল সঙ্গীত পিপাসু। তাঁর বাবা ছিলেন গায়ক আলি বক্স খান। পাঁচ বছর বয়সে পিতৃস্থানীয় চাচা কালে খান ও পরবর্তীকালে বাবার কাছ থেকে কণ্ঠ সঙ্গীতে দীক্ষিত হন বড়ে গোলাম আলি খান। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর পাকিস্তানেই চলে যান তাঁরা।
কিন্তু পাকিস্তানে ধর্মীয় গোঁড়ামির জাঁতাকলের মুখে পড়ে তাঁর সঙ্গীতের কদর সেখানে মেলেনি মোটেও। তাই এই অবহেলা ওস্তাদজির পক্ষে মেনে নেওয়া অত্যন্ত কষ্টকর হয়ে উঠেছিল। তবুও শত কষ্ট বুকে নিয়ে নয়টি বছর পাকিস্তানেই কাটিয়ে দিলেন বড়ে গোলাম আলি খান। এসময় মাঝেমাঝে অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণে ভারতে আসতেন ওস্তাদজি । ভারতে এসে সংগীতের প্রতি সবার গভীর ভালোবাসা দেখে মুগ্ধ হন তিনি। আর এই ভালোবাসার কারণেই এক সময়ে তিনি ভারতে স্থায়ী হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। বলেন- যে দেশে গুণের মর্যাদা নেই, সেখানে গুণী জন্মাবে কেমন করে?
১৯৫৭ সালে একবার এক অনুষ্ঠানে তিনি মুম্বাইয়ের এক অনুষ্ঠানে এলেন। এসময় সেখানে শ্রোতাদের মধ্যে বসে ছিলেন তৎকালীন মুম্বাইয়ের মুখ্যমন্ত্রী মোরারজি দেশাই। যিনি পরবর্তীকালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। বড়ে গোলাম আলি খানের সংগীত জাদুতে সকলে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গেলেন তিনি।
গান শেষের পরে মোরারজি দেশাই আসন ছেড়ে উঠে গিয়ে বড়ে গোলাম আলির (Bade Ghulam Ali) হাত দুটি চেপে ধরে বললেন, “আপনাকে আর যেতে দেব না। এই দেশে আপনি নয়নের মণি হয়ে থাকুন।” এতদিন এটাই তো চাইছিলেন বড়ে গোলাম আলি। সে চাওয়া যে খোদ উপরমহল থেকে আসবে, তিনি ভাবেননি।
কিন্তু এদেশে কোথায় থাকবেন তিনি? এক মুহূর্তে তার সমাধান করে দিলেন মোরারজি দেশাই। ভারতীয় নাগরিকত্বের সঙ্গে সঙ্গেই মুম্বাই, কলকাতা, হায়দেরাবাদ– দেশের এই তিন শহরে বড়ে গোলাম আলি খান সাহেবের থাকার বন্দোবস্ত হয়ে গেল। ভারত পেল এক প্রতিভাবান সঙ্গীতরত্ন।
এরপর থেকে মুম্বইয়ের মালাবার হিলের একটি বাংলোয় বসবাস করতে লাগলেন বড়ে গোলাম। তৎকালীন সঙ্গীত ধারাকে আমুল বদলে ফেললেন তিনি। ঠুমরি আর টপ্পার মিশ্রণে তৈরি করলেন এক নবরূপের সঙ্গীতধারা। ‘সুরমণ্ডল’, এক নতুন বাদ্য প্রাণ পেত খাঁ সাহেবের হাতে। এভাবে একদিন এই ওস্তাদজিকেই বাবা বলে ডাকলেন ব্রাহ্মণকন্যা সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়।
গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গীতগুরু ছিলেন প্রবাদপ্রতিম বড়ে গোলাম আলি খান (Bade Ghulam Ali)। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের পরিমণ্ডলে সন্ধ্যার মেয়েবেলা কেটেছিল। প্রথমেই বলতে হয় সন্ধ্যার বড়দা রবীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের কথা। যিনি সন্ধ্যার গানে আগ্রহ দেখে বোনকে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের শ্রেষ্ঠ গুরুদের কাছে নিয়ে যান।
সন্ধ্যার প্রথম শিক্ষাগুরু আচার্য যামিনী গঙ্গোপাধ্যায়। দীর্ঘ ছ’বছর তাঁর কাছে তালিম নেন সন্ধ্যা। এরপর অল্প কিছুদিন পণ্ডিত চিন্ময় লাহিড়ীর ছাত্রী ছিলেন তিনি। একদিন সন্ধ্যা তাঁর বড়দা রবীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের কাছে বড়ে গোলাম আলি খান সাহেবের কাছে গান শেখার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। রেডিও আর গ্রামাফোনে খান সাহেবের গান শুনে নাবালিকা সন্ধ্যার কানে খেলত শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের সুরমাধুরী। সেসময় বড়ে গোলাম আলি খান কলকাতায় এলে পরম সংগীতজ্ঞ জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের ডিকসন লেনের বাড়িতে উঠতেন। সেখানেই বাংলার ছাত্রছাত্রীদের তালিমও দিতেন তিনি। মীরা বন্দ্যোপাধ্যায় (চট্টোপাধ্যায়) ইতিমধ্যেই তাঁর শিষ্য হয়েছিলেন। সন্ধ্যা আর মীরা ছিলেন সতীর্থ। তাই সন্ধ্যার বড়দা সোজা চলে গেলেন জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের বাড়িতে। খুব শীঘ্রই জ্ঞানপ্রকাশ বাবু সন্ধ্যার বড়দাকে জানালেন, খান সাহেব সন্ধ্যাকে তাঁর শিষ্যা করতে সম্মত হয়েছেন।
একদম প্রথাগত ভাবেই সন্ধ্যা দীক্ষা নিলেন খান সাহেবের কাছে। ১৯৪৯ সালের এক শীতের সকালের পূণ্য দিনে সমস্ত উপচার সাজিয়ে সন্ধ্যা হাজির হলেন ডিকসন লেনের বাড়িতে। এই প্রথম গ্রামাফোনে শোনা খান সাহেবকে নিজের চোখে দেখার সুযোগ পেলেন সন্ধ্যা। সুরমণ্ডল বাজাচ্ছেন খান সাহেব (Bade Ghulam Ali)। এরপর বিরাট এক গোল ট্রে-তে নানাবিধ উপকরণ থেকে মোটা লালসুতো তুলে নিয়ে খান সাহেব বেঁধে দিলেন সন্ধ্যার হাতে। শিষ্যার মুখে দিলেন একটু ছোলা আর গুড়। গান্ডা বাঁধা হল। গুরু-শিষ্যা বাঁধা পড়লেন এক সাঙ্গীতিক বন্ধনে। পিতৃসম গুরুকে সন্ধ্যা ‘বাবা’ বলে ডাকলেন, আর মাতৃসমা গুরুপত্নীকে ‘মা’। অত বড় দেবতাতুল্য সঙ্গীতসাধকের চরণাশ্রিত হতে পেরেই সন্ধ্যার জীবন সার্থক। আনুষ্ঠানিক ভাবে খান সাহেবের শিষ্যা হলেন সন্ধ্যা।
বাবা খান সাহেব এবার গান গাইতে বললেন সন্ধ্যাকে। অভয় দিলেন জ্ঞানপ্রকাশ ও গুরু স্বয়ং। সন্ধ্যা গাইলেন জৌনপুরী রাগ। কিছুক্ষণ শোনার পর গুরু সেটিই শেখাতে লাগলেন। শুরু হল কঠিনতর সঙ্গীত শিক্ষা। পাতিয়ালা ঘরানার স্বরক্ষেপণ রপ্ত করতে গুরু শিষ্যাকে বলেছিলেন, “এক ভাগ সিখনা তো তিন ভাগ সুননা।” কথাটা কী ভীষণ সত্যি! যা খুব কম লোকই মানেন এ যুগে।
লতা চাইলেন না বড়ে গোলাম আলি খানের পরেই গান গাইতে লতা মঙ্গেশকর নিজের আইডল মানতেন বড়ে গোলাম আলি খান সাহেবকে। পঞ্চাশের দশকের শুরুতেই কলকাতার রাজভবনে এক তারকাখচিত সঙ্গীতানুষ্ঠান হয়। সে বার কলকাতায় প্রথম আসা লতা মঙ্গেশকরের। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় কলকাতা দেখাতে এনেছেন লতাকে। লতা উঠেছেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের পৈতৃক বাড়িতেই।
পঞ্চাশের দশকে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল ছিলেন হরেন্দ্র কুমার মুখোপাধ্যায়। তখন রাজভবনের ভিতর ‘স্টারস অফ ইন্ডিয়া শো’ বলে বিখ্যাত অনুষ্ঠান হয়েছিল। সেই অনুষ্ঠানটি আয়োজন করেছিলেন উৎপলা সেন এবং তৎকালীন রেডিও স্টেশন ডিরেক্টর বিমান ঘোষ। চ্যারিটেবল অনুষ্ঠান ছিল এটি। এই অনুষ্ঠান থেকে সংগৃহীত টাকা দিয়ে কার্শিয়াংয়ের টিবি হাসপাতাল তৈরি হয়েছিল। উৎপলা সেনের উদ্যোগে সমস্ত অর্থ তুলে দেওয়া হয় সরকারকে এবং সারা ভারতের শিল্পী-সহ সমস্ত বম্বের শিল্পীরা এই অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন। আলাউদ্দিন খাঁ সাহেব, বড়ে গোলাম আলি খাঁ সাহেবও এসেছিলেন। কলকাতায় রাজভবনে তিনদিন ব্যাপী এই তারকাখচিত অনুষ্ঠানে উৎপলা সেনের আইডিয়া ছিল, দর্শক অতিথিদের মাঝে ঘুরে ঘুরে স্টাররা দানপত্র হাতে অর্থ সংগ্রহ করবেন। দিলীপ কুমার, রাজ কাপুর, নার্গিস, বৈজয়ন্তীমালা– এভাবেই অর্থ সংগ্রহ করেন দর্শকদের মাঝে গিয়ে।
উৎপলা সেনের পুত্রবধূ পারমিতা সেন জানাচ্ছেন, “অনুষ্ঠান মঞ্চে সবে গান শেষ করেছেন বড়ে গোলাম আলি খান। তারপর লতা মঙ্গেশকরকে গান গাইতে ডাকা হয়েছে। কিন্তু লতা চাইলেন না বড়ে গোলাম আলি খানের (Bade Ghulam Ali) পরেই সঙ্গীত পরিবেশন করতে। কী করা যায়, দর্শকদের তো অপেক্ষা করিয়ে মঞ্চ ফাঁকা রাখা যাবে না। উৎপলার সঙ্গে তখন সতীনাথের বিয়ে হয়নি। সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের কাছে গান শিখতেন উৎপলা। আয়োজক হিসেবে উৎপলা তখন সতীনাথকেই বললেন, মঞ্চে উঠে একটু ম্যানেজ করে গান গেয়ে দিতে। সতীনাথের গানে মুগ্ধ হলেন শ্রোতারা। সতীনাথ নামলেন, লতা মঞ্চে উঠলেন। সতীনাথকে বড়ে গোলাম আলি খান বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘তু সতীনাথ নেহি শিউনাথ হ্যায়।’…”
তবে এখানেই শেষ নয় সেদিন লতার গানেও মুগ্ধ হয়েছিলেন বড়ে গোলাম আলি। নিজের পাশে বসিয়ে লতাকে আবার গাইতে বলেন তিনি। লতা বলেছিলেন যে এই নিয়ে দ্বিতীয়বার কোন সঙ্গীত দেবতার পাশে বসে তিনি গাইলেন। প্রথম গেয়েছিলেন বাবা দীননাথ মঙ্গেশকরের পাশে বসে। যে বড়ে গোলাম আলি খানের পর লতা গান গাইতে ভয় পাচ্ছিলেন সেই বড়ে গোলাম সাব লতার গান শুনে মন্তব্য করেছিলেন “কমবখ্ত কাভি বেসুরি নেহি হোতি!” (এই মেয়ে তো কখনই সুর ভুল করে না!) ১৯৫৩ সালেই মুক্তি পেয়েছিল ‘আনারকলি’। এই ছবির একটি গান শ্রোতাদের মন ছুঁয়ে যায়। “ইয়ে জিন্দেগি উসিকি হ্যায়”, এই গানে কণ্ঠ ছিল লতার। সেই গান শুনে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন বড়ে গোলাম আলি খান।
বড়ে গোলামকে ফিল্মে গাওয়ানো হল বড় অঙ্কের পারশ্রমিক দিয়েই
ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলি খানকে বলা হত সে যুগের তানসেন। তিনি চলচ্চিত্রে প্লে ব্যাক করতে কখনও রাজি ছিলেন না। তাঁর এই অনিচ্ছাকেই আরও পোক্ত করেছিলেন সঙ্গীত পরিচালক রাইচাঁদ বড়াল ও অভিনেতা অসিতবরণ। তাঁরা বড়ে গোলাম আলিকে বোঝান, ‘আপনার নামেই তো রয়েছে বড়। এত বড় মাপের গায়ক হয়ে আপনি কেন ফিল্মে গলা দেবেন।’ তাই চিরকাল মেহফিলে মোটা অঙ্কের পারিশ্রমিকেই তিনি গান গেয়েছেন। জনপ্রিয় চলচ্চিত্র নির্মাতা ও সঙ্গীত পরিচালকদের কাছ থেকে অনুরোধ আসা স্বত্ত্বেও সুদীর্ঘকাল চলচ্চিত্রে গান প্লেব্যাক করা থেকে নিজেকে বিরত রাখেন।
কিন্তু ‘মুঘল-ই-আজম’ ছবিতে তানসেনের গান ছিল। পরিচালক প্রযোজককে আসিফ ছবির সঙ্গীত পরিচালক নৌশাদকে জিজ্ঞেস করলেন তানসেনের গান কাকে দিয়ে গাওয়াবেন? নৌশাদ বললেন “এ গান একজনই গাইতে পারবেন। এ যুগের তানসেন বড়ে গোলাম আলি খান।” নৌশাদের সঙ্গে বড়ে গোলামের পূর্ব পরিচয় ছিল। নৌশাদ আসিফকে নিয়ে গেলেন ওস্তাদজির বাড়ি। ওস্তাদজি ফিল্মে গান গাওয়ার কথা শুনেই না করে দিলেন। শেষমেষ নৌশাদ ওস্তাদজিকে পাশের ঘরে ডেকে নিয়ে গেলেন বোঝাতে।
বড়ে গোলাম আলি বললেন, ‘ওই পরিচালককে ভাগাব কী করে সে কথা বল!’ নৌশাদ বললেন ‘আপনি যা পারিশ্রমিক চান উনি তাই দেবেন, এর পরও কি গাইবেন না!’ বড়ে গোলাম আলি ভাবলেন, বিশাল অঙ্কের টাকা চাইলে প্রযোজক নিজেই বিদায় নেবে। আবার বৈঠকখানায় ফিরে গিয়ে বড়ে গোলাম আলি কে আসিফকে বললেন, তিনি ২৫ হাজার টাকা চান। যেখানে এই ফিল্মেই প্লে ব্যাকের জন্য লতা মঙ্গেশকর ও মহম্মদ রফি গানপ্রতি ৫০০ টাকার কম পারিশ্রমিক পেতেন। ফল হল উল্টো। কে আসিফ বড়ে গোলাম আলিকে ২৫ হাজার টাকা দিতেই রাজি হলেন। শুধু তাই নয়, তখনই ১০ হাজার টাকা অগ্রিম দিয়ে গেলেন। আর না করার উপায় ওস্তাদজির ছিল না।
তবে এক বাক্যেই তিনি গান গেয়ে দেননি। আসিফ গানের দৃশ্য নানাভাবে বোঝালেও বড়ে গোলাম আলি গাইতে সম্মত হন না। তাঁর জন্য ফিল্মের দৃশ্যায়ন দেখানোর ব্যবস্থা করা হয়। আনারকলি মধুবালার বডি ল্যাঙ্গুয়েজ পর্দায় দেখে সেই অনুযায়ী গলায় রাগ মাধুরী খেলান বড়ে গোলাম আলি। আর তার পর তো ‘প্রেম যোগন বনকে’ এই গান, এই ছবি ইতিহাস। আনারকলি দেখা করতে যাচ্ছেন সেলিমের কাছে, গানটি গাইছেন তানসেন। ওস্তাদজির মাদকতাময় গলায় সঙ্গে মাঝেমধ্যে আনারকলির নূপুরের আওয়াজ। কী অপূর্ব সৃষ্টি।
উত্তমকুমারের আইডল ছিলেন বড়ে গোলাম আলি
বড়ে গোলাম আলি খান সাহেব ও তাঁর পরিবার পাকাপাকি ভাবে কলকাতায় এলেন ১৯৬৩ সালের প্রথম দিকে। ওঁরা এসে উঠলেন থিয়েটার রোডের ‘হাতোয়া হাউস’-এ। বাড়িটা ছিল হাতোয়ার মহারাজার। তাঁরই অতিথি হিসেবে এই শহরে প্রথম ক’টা দিন কাটালেন খান সাহেব ও তাঁর পরিবার। এ শহরের শাস্ত্রীয়সঙ্গীতপ্রেমী শ্রোতারা খান সাহেবের গান শুনতে পেরে ধন্য হলেন। শহর জুড়ে একের পর এক অনুষ্ঠান তখন খান সাহেবের। খান সাহেব বলেছিলেন, কলকাতার দর্শকদের সঙ্গীতের সঙ্গে সম্পর্কটা মন থেকে আসে। শুধুমাত্র দেখনদারি নয়।
ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলি খাঁকে অসম্ভব শ্রদ্ধা করতেন উত্তমকুমার। উত্তম কুমারদের মরসুমি ক্লাবের একটা ঘরোয়া অনুষ্ঠানে খান সাহেবের গান শোনানোর ইচ্ছে হয়েছিল তাঁর। কিন্তু খান সাহেবকে গান গাওয়ানো কী এতই সোজা! সেই অনুষ্ঠানে আসার জন্য আমন্ত্রণ জানাতে উত্তমকুমার গিয়েছিলেন খাঁ সাহেবের বাড়ি। তাঁর ছেলে মুনাব্বর খান সাহেব ছিলেন উত্তমকুমারের বন্ধু। সকালে যখন খান সাহেবের বাড়িতে গিয়ে পৌঁছলেন উত্তমকুমার, শুনলেন খান সাহেব রেওয়াজে বসেছেন। রেওয়াজের সময় তিনি কারও সঙ্গে দেখা করেন না।
তবু মুনাব্বর বৈঠকখানায় উত্তমকুমারকে বসিয়ে রেখে বাবাকে খবর দিতে গেছিলেন। মিনিট দুয়েকের মধ্যে ফিরে এসেই মুনাব্বর বললেন, আপনার জন্য আমাকে বাবার কাছে বকুনি খেতে হলো। উত্তম বললেন, কেন! মুনাব্বর বললেন, আপনার মতো মসুর কলাকারকে কেন বৈঠকখানার ঘরে বসিয়ে রেখেছি? কেন সঙ্গে করে নিয়ে যাইনি? সেই জন্য।
অথচ বড়ে গোলাম আলি সাহেবেরই নিয়ম ছিল রেওয়াজের সময় কারও সঙ্গে দেখা করবেন না। মুনাব্বরের সাথে ভেতরে গিয়ে উত্তমকুমার দেখলেন, খান সাহেব রেওয়াজ করছেন। তবে রেওয়াজ করতে করতেই ওঁদের সব কথা শুনলেন এবং যে রাগ অনুশীলন করছিলেন, সেই রাগের সুরেই শব্দ ফেলে ফেলে সব প্রশ্নের উত্তর দিলেন। আসতেও রাজি হলেন মরসুমি ক্লাবের জলসায়।
মরসুমি ক্লাবের জলসায় বড়ে গোলাম আলিকে মহানায়ক দিয়েছিলেন এক হাজার টাকা আর গৌরীদেবী বড় এলাচের মালা শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসেবে পরিয়ে দেন ওস্তাদজীকে। গৌরী দেবী কারও মুখে শুনেছিলেন, ওস্তাদজির প্রিয় বড় এলাচ। লম্বা মালাটিতে ছিল এক হাজার আটটা বড় এলাচ।
কোনও পারর্ফমারকে প্রতিটা মুহূর্তে যে অনুশীলনের মধ্যে থাকতে হয়, উত্তমকুমার তা বারবার প্রমাণ করেছেন। তাই ছায়াছবিতে তাঁর প্রতিটি চরিত্র আজও আইকনিক। প্রতিটি চরিত্র হয়ে ওঠার প্রস্তুতিতে থাকত উত্তমকুমারের নিরলস অনুশীলন।
পরবর্তীকালে আরেকবার খান সাহেবের বাড়ি যেতে হয় উত্তমকুমারকে। তখন ‘স্ত্রী’ ছবির শুটিং চলছে। সকালে খান সাহেবের পার্ক সার্কাসের বাড়িতে গিয়ে হাজির মহানায়ক। খান সাহেব তখন রেওয়াজে বসেছেন। সঙ্গে কেরামতুল্লাহ আছেন। আছেন মীরা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। তরুণ কুমারকে সঙ্গে নিয়ে উত্তমকুমার পৌঁছাতেই মুনাব্বর তাঁকে নিয়ে আপ্যায়ন করে বসালেন। খান সাহেব রেওয়াজ করছিলেন, তাঁর সামনে চিকের আড়াল ছিল। চিকের এপারে বসলেন উত্তমকুমার।মুনাব্বরকে উত্তমকুমার বললেন, “ওঁর সঙ্গে আমার আলাদা করে দেখা করবার দরকার নেই। আমি এখান থেকেই ওঁর রেওয়াজ একটু দেখব। ওঁকে ডেকে বিরক্ত করার দরকার নেই।”
খান সাহেব রেওয়াজের সময় কীভাবে আচার-আচরণ করেন, সংগীতের তালে তালে তাঁর মাথা, হাত, শরীর কীভাবে নড়াচড়া করে, সেই সমস্ত আবারও খুব যত্ন করে দেখলেন উত্তমকুমার। খানিকক্ষণ পরে মুনাব্বরকে বলে তরুণ কুমারকে নিয়ে বেড়িয়ে গেলেন।
আদতে ‘স্ত্রী’ ছবিতে ধ্রুপদাঙ্গ গানে কীভাবে শট দেবেন, সেটা বুঝতেই এসেছিলেন। ভাবা যায় ‘হাজার টাকার ঝাড়বাতিটা’ গানে যে অসাধারণ লিপ দিয়েছিলেন উত্তমকুমার, সেই সব বডি ল্যাঙ্গুয়েজ তিনি ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলি খানের থেকেই রপ্ত করেছিলেন।
শুধু গান নয় ওস্তাদজির রান্নার হাত ছিল অপূর্ব
বড়ে গোলাম আলি খান শুধু যে সঙ্গীতের দেবতা ছিলেন তাই নয়, তাঁর ছিল আরও অনেক গুণ। গানের ফাঁকে আড্ডায় অন্য শিল্পীরা কেমন ভাবে গান পরিবেশন করেন, সেগুলো মিমিক্রি করে দেখাতেন। আবার তিনি ছিলেন অসাধারণ রাঁধুনিও। আসলে ছোট থেকেই তিনি গান শেখার ফাঁকে সঙ্গীতগুরু চাচা কালে খানকে রান্না করে খাওয়াতেন। সেই থেকে পাকা রাঁধুনিও হয়ে গেলেন। ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলি খানের হাতের স্পেশাল রান্না ছিল পাকিস্তানি পোলাও। নানা পদের বিরিয়ানিও রাঁধতেন। খেতে ও খাওয়াতে ভালবাসতেন মিষ্টি।
তবে নিজে খুব একটা খেতেন না। অনেকেই ভাবেন, বেশি খাওয়ার জন্যেই বড়ে গোলাম আলি খান এত স্থুলকায় চেহারার ছিলেন। আদতে তিনি থাইরয়েডে আক্রান্ত ছিলেন। সঙ্গে ছিল হাইসুগার। তাই মিষ্টি ছিল একদম বারণ। তাঁর থেকে সব মিষ্টি লুকিয়ে রাখতেন বাড়ির লোকেরা। কিন্তু নাতি লুকিয়ে মিষ্টি এনে দাদুর মুখে পুরে দিত। আদতে নাতিকে নির্দেশ দিতেন ওস্তাদজিই। ছেলের কাছে ধরা পড়ে গেলে বড়ে গোলাম আলি খান বলতেন, “আরে আমি খাচ্ছি না। নাতিকে খাওয়াতে গিয়ে নিজের মুখে একটু পুরে ফেলেছি।”
এমনই মজার মানুষ ছিলেন তিনি।
সরস্বতীর বরপুত্রর শেষদিনেও সঙ্গী ছিল গান
শেষজীবনে জরা এলেও জীবনের শেষদিন অবধি গান গেয়ে গেছেন বড়ে গোলাম আলি খান। গান ছাড়া নিজেকে ভাবতে পারতেন না তিনি। ১৯৬৮ সালের ২৩ এপ্রিল মাত্র ৬৬ বছর বয়সে হায়দেরাবাদের বাঁশেরবাগ প্যালেসে এই সঙ্গীত দেবতার দেহাবসান ঘটে। জীবনের শেষের বছরগুলোয় দীর্ঘদিনের অসুস্থতাজনিত কারণে আংশিক পঙ্গু হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। শয্যাশায়ী হয়েই জীবনের শেষ দিনগুলি কাটিয়েছিলেন। তবে মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত পুত্র মুনাব্বর আলি খানকে সহায়তার ছলে গান পরিবেশন করে গেছেন।
সঙ্গীতজীবনে পেয়েছিলেন সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমি ও পদ্মভূষণ পুরস্কার। যদিও পুরস্কার নিয়ে তাঁর কোনও আগ্রহ ছিল না। হায়দরাবাদের বাঁশেরবাগের প্রধান রাস্তাটি তাঁর সম্মানে নামাঙ্কিত হয়েছে। সরস্বতীর বরপুত্র স্বর্গের মেহফিলে ব্যস্ত হয়ে পড়লেও তাঁর সুরমূর্চ্ছনায় আজও মুগ্ধ শ্রোতারা।
ফুলের কাছে নারীর কাছে
বুকের বিপুল ব্যথার কাছে
বেদনাবহ যে সব কথা
বলতে গিয়ে ব্যর্থ হলাম।
তারাই যখন ফিরে আসে
কেউ ললিতে কেউ বিভাসে
স্পন্দনে তার বুঝতে পারি
বুকের মধ্যে বড়ে গোলাম।