
বিপ্লব রায়।।
বয়স মাত্র ৩৭। আর এই বয়সেই নন্দিত নেতা হিসেবে বিশ্বজুড়ে নিজের অবস্থান করে নিলেন আফ্রিকার দেশ বুরকিনা ফাসোর ইব্রাহিম ত্রাওরে বুঝতে পেরেছিলেন- পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ ও নয়া উপনিবেশবাদ শুধু আফ্রিকা নয়, কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে গোটা বিশ্বকে। তাই তাদের কবল থেকে নিজের দেশকে মুক্ত করার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ তরুণ নেতা ইব্রাহিম ত্রাওরে।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ইনডিপেনডেন্ট বলছে, ইব্রাহিম ত্রাওরে আফ্রিকার সবচেয়ে কম বয়সী নেতা। কারণ এই মহাদেশ সব সময়ই প্রবীণ রাজনীতিবিদ ও তাঁদের কঠোর শাসন দেখে অভ্যস্ত। এ অবস্থায় সেই শৃঙ্খল মুক্ত করার ভিন্ন এক আবেদন নিয়ে এসেছেন তরুণ ইব্রাহিম।
২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে দ্বিতীয় অভ্যুত্থানের পর ক্ষমতায় আসেন ইব্রাহিম ত্রাওরে। এরপর থেকে তিনি পশ্চিমাদের, বিশেষ করে সাবেক ঔপনিবেশিক শাসক ফ্রান্সের কাছ থেকে বেড়িয়ে নিজেদের স্বনির্ভরতা ও স্বাধীনতার ওপর একের পর এক কথা বলে আসছেন। সেসব বক্তৃতা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর ব্যাপক ভাবে সমাদৃত হয়। অন্যদিকে পশ্চিমাদের মুখে চপেটাঘাত করা সেসব বক্তৃতা খুব সহজ এবং স্পষ্ট বার্তা দেয় যে- ‘বুরকিনা ফাসো আর পশ্চিমাদের পা চাটবে না।’
ইব্রাহিম ত্রাওরের জন্ম ১৯৮৮ সালের ১৪ মার্চ। তিনি একজন বুরকিনাবি সামরিক কর্মকর্তা। যিনি ২০২২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বরের অভ্যুত্থানের পর থেকে বুরকিনা ফাসোর অন্তর্বর্তীকালীন নেতা হন, যা অন্তর্বর্তী রাষ্ট্রপতি পল-অঁরি সাঁদাওগো দামিবাকে ক্ষমতাচ্যুত করে।। ৩৪ বছর বয়সে বিশ্বের সবচে’ কম বয়সী প্রেসিডেন্ট হন ইব্রাহিম ত্রাওরে। অভুত্থানের পর ফ্রান্স বিরোধী ধারণা পোষণ করার কারণে বিশ্বব্যাপী পরিচিত হয়ে ওঠেন তিনি।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, বিদেশি গোষ্ঠীর ইন্ধনে বুরকিনা ফাসোতে ইব্রাহিম ত্রাওরের বিরুদ্ধে সম্প্রতি আবারও অভ্যুত্থানের চেষ্টা শুরু হয়।
আফ্রিকায় মার্কিন সামরিক শাখার প্রধান জেনারেল মাইকেল ল্যাংলে বলেন, ক্ষমতায় এসে ইব্রাহিম ত্রাউরে সোনার মজুত নিয়ে টালবাহানা করছেন। এরপরই ইব্রাহিম ত্রাউরেকে সমর্থন জানিয়ে গত এপ্রিলে রাস্তায় নামে জনতা। ওই সময় রাজধানীর ওয়াগাডুগুতে সেই জনতার ঢল ইব্রাহিম ত্রাউরেকে আরো উচ্চতায় নিয়ে যায়। সাধারণ জনতা ত্রাউরেকে তখন জানিয়ে দেন, ‘কোনো কিছু তোয়াক্কা না করে ইব্রাহিম তুমি এগিয়ে যাও। আমরা তোমার সঙ্গে আছি।’ কারণ, ওই দেশের সাধারণ মানুষ বুঝে গেছে, ইব্রাহিম ত্রাউরে কখনোই বিদেশি শক্তির কাছে বুরকিনো ফাসোর মানুষের স্বার্থ বিসর্জন দিবে না।
আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, পশ্চিমাবিরোধী মনোভাব ও তারুণ্য ইব্রাহিমকে তরুণদের নেতায় পরিণত করেছে। বুরকিনা ফাসো সীমান্তের কাছে বসবাসকারী ঘানার রিচার্ড আলানডু বলছেন, ‘দেশ-বিদেশে আফ্রিকান তরুণদের মধ্যে এই চেতনা ক্রমেই বাড়ছে যে, তাদের মহাদেশের অগ্রগতিতে বাধা সম্পর্কে কিছু করা দরকার। মনে হচ্ছে ত্রাউরে সেই চেতনার প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছেন।’
আন্তর্জাতিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান কন্ট্রোল রিস্কসের জ্যেষ্ঠ গবেষক বেভারলি ওচেং বলেছেন, কেনিয়া থেকেও আমি অনেক রাজনীতিবিদ ও লেখকদের বলতে শুনেছি-এই তো সেই মানুষ, যাঁকে আমরা বহুদিন ধরে খুঁজছিলাম।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, পশ্চিম আফ্রিকায় তরুণদের ক্ষমতা দখলের ইতিহাস আগে থেকেই। যেমনটি ১৯৮০ দশকে ঘানায় জন জেরি রাওলিংস, লাইবেরিয়ার স্যামুয়েল ডো এবং বুরকিনা ফাসোতে থমাস সাঙ্কারাকে দেখা যায়। আফ্রিকায় পশ্চিমা ধাঁচের গণতন্ত্রের ব্যর্থতার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো সেই ইতিহাস ত্রাউরের মতো ব্যক্তিদের ‘আদর্শ’ হিসেবে গড়ে ওঠার পরিবেশ তৈরি করে। তবুও, আফ্রিকার সবচেয়ে কনিষ্ঠ শাসককে ঘিরে সাধারণ মানুষের মধ্যে যে আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে, তাকে কেবল ‘প্রচারণার ম্যাজিক’ বলে ব্যাখ্যা করা যায় না।
আফ্রিকার বিশ্লেষক এবং টাফ্টস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক চিডি ওডিনকালু মন্তব্য করে বলেছেন ‘ত্রাউরে এমন একটি বিপ্লবী বার্তা প্রকাশ করেছেন, যা তাদের দেশে গণতন্ত্র হারিয়ে যাওয়ার কারণে হতাশ তরুণ জনগোষ্ঠীর কাছে বেশ আগ্রহ তৈরি করেছে।’
গত কয়েক বছর ধরে রাজনৈতিক সংকট, নিরাপত্তাহীনতা ও অর্থনৈতিক অস্থিরতার মধ্য দিয়ে কাটাচ্ছে পশ্চিম আফ্রিকার ছোট্ট দেশ বুরকিনা ফাসো। আর এই অবস্থার মধ্যেই ত্রাতা হিসেবে আবির্ভূত হন সাহসী তরুণ নেতা ইব্রাহিম ত্রাউরে। তিনি হয়ে উঠেছেন দেশের তরুণদের আশার প্রতীক।
ত্রাউরের কথা শুধু বুরকিনা ফাসোতেই নয়, ছড়িয়ে পড়েছে আফ্রিকার বাইরেও। অনেকেই মনে করেন, তিনি আফ্রিকার বীরদের পথেই হাঁটছেন। ভক্তরা তাঁকে তুলনা করেন বুরকিনা ফাসোরই আরেক কিংবদন্তি নেতা টমাস সাঙ্কারার সঙ্গে। যিনি ছিলেন একজন মার্কসবাদী বিপ্লবী এবং অনেকের চোখে ‘আফ্রিকার চে গুয়েভারা’।
তবে ২০২২ সালে ক্ষমতায় এলেও এখন পর্যন্ত বড় কোনো অগ্রগতির খবর শুনাতে পারেননি ত্রাউরে। ক্রমেই দেশটিতে রাশিয়ার প্রভাব বাড়ছে। অনেকে মনে করছেন, ইব্রাহিম এখন পুরোপুরি রুশ বলয়ে রয়েছেন । তবে তিনি যে বলয়েই থাকুন, বুরকিনা ফাসোর জনগণ তাকিয়ে আছেন দাসত্ব থেকে পুরোপুরি মুক্তির পথের দিকে।
চমৎকার লিখেছেন জনাব বিপ্লব রায়