
বিপ্লব রায় ।।
চৈত্র সংক্রান্তি বাঙালি হিন্দু সমাজে অন্যতম একটি দিন। শাস্ত্রমতে যুগ যুগ ধরে চলে আসা লোকাচার অনুসারে চৈত্র সংক্রান্তির এই দিনে স্নান, দান, ব্রত ও উপবাস পালন করেন বউ ঝিয়েরা। এ দিন সকাল থেকে এবাড়ি- ওবাড়ি চলে বৌ ঝিয়েদের গঙ্গা পূজা। শঙ্খ ও উলুধ্বনিতে মুখরিত হয় চারপাশ। ঘরের কর্র্তারা নগর কীর্তন নিয়ে ঘরে ঘরে সৃষ্টিকর্তার নাম বিতরণ করেন। এছাড়া সকাল থেকে বাড়িতে বাড়িতে আয়োজন করা হয় চিড়া-মুড়ি-খৈ, নারকেল কিংবা দই, চালের গুঁড়ো ও ফলফলাদি ভোজন। দুপুরে রান্না করা হয় নিরামিষ অষ্টব্যাঞ্জন। যার মধ্যে একটু তেঁতো থাকতে হবে। অর্থা’ গিমি শাক। এই শাক চৈত্র সংক্রান্তির দিনে দুপুরের খাবারে হিন্দু বাড়িতে থাকতেই হবে।
বিকেলে গ্রামে গ্রামে বসতো গ্রামীণ মেলা। এ দিন অনুষ্ঠিত হতো শিবের গাজন বা চড়ক পূজা, আর তার আগের দিন নীল পূজা।
মায়েরা নীলের উপবাস করে সন্তানের মঙ্গল কামনায় এই পুজো দিয়ে থাকেন। এসময় প্রার্থণা করে বলেন- আমার সন্তানের কল্যাণ করো হে নীলকণ্ঠ, সব বিষ কণ্ঠে নিয়ে তাকে অমৃতসুধা দাও! সেই বহুকাল থেকে বাংলা জুড়ে চলে চলে আসছে সেই লোক উৎসব। প্রতি বছর বাংলার গ্রামে গ্রামে এই উৎসব নিয়ে আসে নতুন বছরের আগমন বার্তা।
চড়ক পূজা মূলত: ধর্মঠাকুরের পূজা। কালক্রমে এই পূজা রূপান্তরিত হয় শিবের গাজনে। এই ধর্মঠাকুরের উদ্ভব বৌদ্ধ দেবতা ধর্মরাজ থেকে। বাউরি, বাগদি, হাঁড়ি, ডোম প্রভৃতি গ্রামীণ মানুষেরা এই ধর্মঠাকুরের পূজা করেন। যদিও ধর্মঠাকুরের সেই অর্থে মূর্তি কোথাও দেখা যায় না। পাথরের খণ্ডকেই পূজা করা হয়। কিছু গ্রামে বুদ্ধমূর্তিকেই পূজা করা হয়। কোনো কোনো গ্রামে ধর্মঠাকুর আর শিব দুজনেই গাজনে পূজিত হন। শিবের পূজা হয় বলে চড়ক পূজাকে শিবের গাজনও বলা হয়ে থাকে।
তবে অনেকের মত হচ্ছে- বৌদ্ধধর্মের প্রভাব যখন কমতে থাকে, তখন বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েন। তেমনই কয়েকজন বৌদ্ধ সন্ন্যাসী বাংলায় আশ্রয় নিয়ে সনাতন ধর্ম গ্রহণ করেন। এরপর তাদের বিভিন্ন তন্ত্রমন্ত্রের সাধন সনাতন ধর্মে মিশে যায়। আর এই তান্ত্রিক ক্রিয়া থেকেই পরবর্তী কালে উদ্ভব হয় চড়ক পূজার।
এই পূজায় যোগদানকারী সন্ন্যাসীরা তান্ত্রিক সাধনা অভ্যাসের ফলে নিজেদের শারীরিক কষ্টবোধের ঊর্ধ্বে থাকায় চড়কের মেলায় নানা রকম শারীরিক কষ্ট স্বীকারে তারাই অগ্রণী হয়ে ওঠেন। ৩০-৪০ ফুট উঁচু চড়ক গাছ থেকে তাদের পিঠের চামড়ায় বঁড়শি গেঁথে দড়ি দিয়ে ঝুলিয়ে দেওয়া, জিভে বা শরীরের কোনো জায়গায় লোহার শিক গেঁথে দেওয়া বা ভাঙা কাচের টুকরোর ওপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া, আগুনের খেলা দেখানো ইত্যাদি। তবে বর্তমানে বিপজ্জনক এসব কসরত করতে নিরুতসাহিত করা হয়েছে।
গ্রামে চৈত্রসংক্রান্তির এসব মেলায় উঠতোঅস্থায়ী অসংখ্য দোকান। বাঁশ, বেত, প্লাস্টিক, মাটি ও ধাতুর তৈরি বিভিন্ন ধরনের তৈজসপত্র ও খেলনা, ফল-ফলাদি ও মিষ্টি কেনা-বেচা হতো। নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ সবাই আসতো এই মেলায়। সে এক অন্যরকম আনন্দ। তখন ধর্মের নামে কোথাও কোনো বিশৃঙ্খলা ছিল না। হিন্দু-মুসলিম বলে পার্বণের সময় কোথাও বিভেদ ছিল না। তাই সবাই মিলে অঞ্চলভেদে তিন থেকে চার দিনব্যাপী চলতো বৈশাখী মেলা।
এই মেলায় গম্ভীরা, বায়োস্কোপ, সার্কাস, পুতুলনাচ, ঘুড়ি ওড়ানো কত্ত কী যে থাকত। কিন্তু এখন কালের বিবর্তনে চৈত্রসংক্রান্তির সেই অপার্থিব আনন্দ আর নেই। সব হারিয়ে গেছে সময়ের স্রোতে। এখন সর্বত্র নববর্ষ উদযাপন হলেও তা অধিকাংশ এলাকায়ই হয়ে উঠছে বাণিজ্যিক। এখন এসব অনুষ্ঠানে নতুন ধারা পেয়েছে ঠিক, কিন্তু সেই ভালোবাসা, শ্রদ্ধাবোধ, আন্তরিকতা সব হারিয়ে গেছে।
চৈত্রমাস শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আগে গ্রাম বাংলার প্রকৃতিতে এক অন্যরকম অনুভূতি শুরু হতো। বিশেষ করে তীব্র খরা ও সূর্যের তাপে মানুষগুলোর ছটফট অবস্থা ছিল। তখন গ্রাম তো দূরের কথা, শহরেও সবখানে সহজলভ্য বিদ্যুৎ ছিল না। তাই একটু শীতল বাতাসের আশায় গ্রামের ছেলে-মেয়েরা পুকুর পাড়ে কিংবা গাছের ছায়ায় গিয়ে কাঁচা আম কেটে লবণ-মরিচ মিশিয়ে খেতো। কেউ কেউ দুপুরের ভাত খেয়ে ঘরের বাইরে কোথাও গিয়ে ছোট পাটি কিংবা গামছা বিছিয়ে ঘুমিয়ে পড়তো গাছের ছায়ায়।
চৈত্রমাসে গ্রামের মানুষের মনে একরকম হাহাকার ছিল। সবাইকে এই চৈত্র সংক্রান্তির আগে সব ধারদেনা পরিশোধ করতে হতো। দোকানগুলোতে খোলা হতো খালখাতা। ফলে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের মধ্যে আর্থিক সংকট দেখা দিতো। ছোট ছেলে-মেয়েরা আবার চৈত্র সংক্রান্তির মেলায় গিয়ে কেনাকাটা ও আনন্দ করার জন্য আগে থেকেই টাকা জমিয়ে রাখতো।
এদিকে পরিবারের বড়দের আকাঙ্ক্ষা ছিল, চৈত্র শেষ হয়ে কবে শুরু হবে বৈশাখ । আবার শুরু হবে লেনাদেনা। ব্যবসা-বাণিজ্য।
একটু ভালো থাকার জন্য ঘরে ঘরে কত কামনা চলে মানুষের! চৈত্র ফুরিয়ে আসছে, বৈশাখ শুরু হলো বলে। এভাবেই আগমন ঘটে শুভ বাংলা নববর্ষের।